সোমবার, ৫ জুন, ২০১৭

আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিবছর ৫ জুন এই দিবস পালন করা হয়। কিন্তু, দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বড়ই বেমানান প্রকৃতির ছবি। এই দিনটিতেই জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ কনফারেন্স (United Nations Conference on the Human Environment) শুরু হয়েছিল। এই কনফারেন্স হয়েছিল ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৫ থেকে ১৬ জুন অবধি। এই কনফারেন্স ঐ বছরই চালু করেছিল জাতিসংঘের সাধারণ সভা। তখন থেকেই প্রতি বৎসর এই দিবস পালিত হয়ে আসছে দিবসটি প্রথম পালিত হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। প্রতি বছরই দিবসটি আলাদা আলাদা শহরে, আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে পালিত হয়। উত্তর গোলার্ধে দিবসটি বসন্তে, আর দক্ষিণ গোলার্ধে দিবসটি শরতে পালিত হয়।
 গাছগাছালি মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শুধু মানুষই নয়, গাছপালা ছাড়া কোনো প্রাণীই জীবন ধারণ করতে পারবে না। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বেড়ে পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধানত দায়ী বৃক্ষহীনতা। দিন দিন কমে যাচ্ছে গাছের সংখ্যা। গাছপালার স্বল্পতার কারণে ভূপৃষ্ঠে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ভয়াবহভাবে বেড়ে যাচ্ছে। গাছগাছালির উপকারের কোনো শেষ নেই। একটি গাছ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে।

মানুষেরই কিছু অবিমৃশ্যকারী কাজের ফল জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বের উপর যার প্রভাব মারাত্মক৷ অবশ্য আজ মানুষ ধীরে ধীরে তার কাজের পরিণাম উপলব্ধি করতে পারছে, তাই পরিবেশ সুরক্ষায় সুচেতনার জাগরণও ঘটছে৷ শিশুদের মধ্যেও যে পরিবেশ সংরক্ষণের চেতনা জাগছে৷
কিন্তু মুশকিল হলো, এই শিশুরাই আমাদের মতো বড়দের কাজকর্ম দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে৷  মাটিতে মিশে না যাওয়া ( নন বায়ো ডিগ্রেডেবল) আবর্জনা পরিবেশের ভীষণ ক্ষতি করে৷ একথা আমরা বাচ্চাদেরও শেখাই৷ কিন্তু তারপরই আমাদের বাচ্চারা দেখে, আমরা পলিথিন প্যাকেটে করে বাজার থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসছি, আর সেই পলিথিন যত্রতত্র ফেলে দিচ্ছি৷ এ থেকে শিশুরা শিখছে, ‘এমন অনেক বিষয় আছে, যেগুলি সম্বন্ধে যা শেখানো হয়, তার উল্টোটাই করতে হয়'৷ সমুদ্রসৈকত হোক বা পাহাড়, আমরা পিকনিক করতে যাই, আর বিভিন্ন ক্ষতিকর আবর্জনা আমরা সেখানে ফেলে আসি৷ এমনকি আজ হিমালয়ের উচ্চতম স্থানগুলিও রেহাই পাচ্ছে না৷ একটা ব্যক্তিগত কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার কথা বলি৷ আমার বাচ্চাকে শিখিয়েছি, গাছ কাটতে নেই, লাগাতে হয়৷
     বছর তিনেক আগে হঠাৎ দেখলাম আমাদের আসাম রোড (এস টি কে কে রোড )  চওড়া করার জন্য শতাব্দী প্রাচীন ( হয়ত বা কয়েক শতাব্দী প্রাচীন ) বিরাট বিরাট শিরীষ গাছগুলিকে নির্মমভাবে কেটে ফেলা হলো কোনো নতুন গাছ না লাগিয়েই৷ আমার মেয়ে তিতলি আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘‘বাবা , গাছ কাটা তো খারাপ কাজ, তাহলে এতগুলো গাছ কেটে ফেলল কেন?'' বিশ্বাস করুন, আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি৷ কীভাবে তাকে আমি বলব যে, বড় হলে আমাদের মধ্যে একটা জিনিস জন্ম নেয় যার নাম ‘হিপোক্রেসি'৷ যতক্ষণ না আমরা এই হিপোক্রেসির হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছি, ততক্ষণ আমাদের কথা আর কাজের মধ্যে রয়ে যাবে বিস্তর ফারাক৷ আমরা অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে চলি, ‘কর্তব্য বিষয়ে ভালো ভালো কথার জন্ম হয়েছে আমার বলার জন্য, আর অন্যদের করার জন্য', অন্তত আমার দেশে৷ তাই আমরা স্লোগান দিই, ‘গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান'৷ কখনোই বলি না, ‘এসো গাছ লাগাই, প্রাণ বাঁচাই'৷ আমাদের বাসের পিছনে লেখা থাকে না, ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলি', লেখা থাকে ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন'৷  অর্থাৎ আমার কোনো দায় নেই! আজ আমাদের এস টি কে কে রোড ঝাঁ চকচকে,গাড়ী চলে সাবলীল ভাবে ,বান্ডেল থেকে কাটোয়া পর্যন্ত রাস্তা শুয়ে আছে একটা বড়ো অজগরের মতো,গাড়ি চলছে সাঁ সাঁ করে ,.........ঠা ঠা রোদ্দুরে অজগরের পিঠ চক চক করছে ,আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের সেই ছায়া - সুনিবিড় পথ। খামারগাছী পেরোলেই চোখে পড়ে রাস্তার ধারে পরে আছে শিরীষ ,বাবলা,জারুল,কৃষ্ণচূড়াদের টুকরো টুকরো লাশ।
       তবুও আশার কথা, সর্বত্রই কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ থাকেন, কথা নয়, কাজই যাঁদের জীবনাদর্শ৷ তাঁদের কাজের ফলেই সভ্যতা কালো থেকে আলোর দিকে, মন্দ থেকে ভালোর দিকে এগিয়ে চলে৷ তাঁদের কথা মনে রেখেই আমরা নিজেদের সন্তান-সন্ততির জন্য আগামীদিনে একটু অন্যরকম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে সাহস পাই৷

বিশ্ব পরিবেশ দিবস প্রতি বছরই আসে, আবার চলেও যায়। এই দিনটি পালন করার সময় পরিবেশ সচেতনতার কথা বলেন অনেকেই। তারপরই পরিবেশ রক্ষার কথা ভুলে যায় সবাই। তবুও  কিছু মানুষ বাঁচে নিজের মতো করে সবুজকে সাথে নিয়ে। 

শনিবার, ৩ জুন, ২০১৭

কুরচি

"কশ্চিত্ কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারাত্প্রমত্তঃ
শাপেনাস্তঙ্গমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেণ ভর্তুঃ .
যক্ষশ্চক্রে জনকতনযাস্নানপুণ্যোদকেষু
স্নিগ্ধচ্ছাযাতরুষু বসতিং রামগির্যাশ্রমেষু ..
তস্মিন্নদ্রৌ কতিচিদবলাবিপ্রযুক্তঃ স কামী
নীত্বা মাসান্ কনকবলযভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠঃ .
আষাঢস্য প্র(শ)থমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীডাপরিণতগজপ্রেক্ষণীযং দদর্শ ..
তস্য স্থিত্বা কথমপি পুরঃ কৌতুকাধানহেতোঃ
অন্তর্বাষ্পশ্চিরমনুচরো রাজরাজস্য দধ্যৌ .
মেঘালোকে ভবতি সুখিনোঽপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ
কণ্ঠাশ্লেষপ্রণযিনি জনে কিং পুনর্দূরসংস্থে ..
প্রত্যাসন্নে নভসি দযিতাজীবিতালম্বনার্থী
জীমূতেন স্বকুশলমযীং হরযিষ্যন্ প্রবৃত্তিম্ .
স প্রত্যগ্রৈঃ কুটজকুসুমৈঃ কল্পিতার্ঘায তস্মৈ
প্রীতঃ প্রীতিপ্রমুখবচনং স্বাগতং ব্যাজহার .. " মেঘদুতম ( Meghaduuta
Kalidasa’s Cloud Messenger)
হিমালয় পর্বতের মানস সরোবরের সন্নিকটে অলকাপুরী নামে এক মনোরম রাজ্য ছিল। তার অধিপতি কুবের। এদের বলা হতো দেবতা [আসলে মানুষ]। স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সুখী। সেই কুবের রাজার এক কর্মচারী যক্ষ একদিন বাগান পাহারার কাজে অবহেলা করেছিল। সেই অপরাধে তাকে এক বছরের জন্য নির্বাসন দিয়ে পাঠিয়ে দিল বিন্ধ্য পর্বতের রামগিরিতে। ওদিকে ঘরে, একাকিনী প্রিয়া। নির্বাসনে আট মাস কোনোমতে কেটে গেল। এসে গেছে বর্ষা। মৌসুমি মেঘ চলেছে উত্তর দিকে হিমালয়ে। অমনি যক্ষ ঠিক করল মেঘকে দূত করে খবর পাঠাবে প্রিয়তমার কাছে। তখন, হাজার দেড়েক বছর আগে ডাক বিভাগ ছিল না। মেঘ ছাড়া কে খবর নিয়ে যেতে পারবে? যক্ষ তাই বসন্ত-গ্রীষ্মে ফোটা কুর্চি ফুল দুই হাতে নিয়ে মেঘকে 'মোহন, প্রীতিময় বচনে' জানাল তার দুঃখের কথা। এই নিয়ে কালিদাস লিখেছেন 'মেঘদূত' নামক বিখ্যাত কাব্য। গ্রীষ্ম-বর্ষার এত ফুল থাকতে কুর্চি ফুল কেন বেছে নিলেন কালিদাস বা তাঁর নায়ক যক্ষ নামক সাধারণ মানুষটি! বিরহী যক্ষ নবীন মেঘ দেখে বলছে...............
'কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে যদি-না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গল-বার্তা? যক্ষ অতএব কুড়চি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য স্বাগত-সম্ভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।'
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও কুড়চির সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলেন , তিনি তাঁর বনবানী গ্রন্থে লিখেছিলেন.................. " অনেককাল পূর্বে শিলাইদহ থেকে কলকাতায় আসছিলেম। কুষ্টিয়া স্টেশনঘরের পিছনের দেয়ালঘেঁষা এক কুরচিগাছ চোখে পড়ল । সমস্ত গাছটি ফুলের ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত। চারি দিকে হাটবাজার ; এক দিকে রেলের লাইন , অন্য দিকে গোরুর গাড়ির ভিড় , বাতাস ধুলোয় নিবিড়। এমন অজায়গায় পি.ডব্লু.ডি-র স্বরচিত প্রাচীরের গায়ে ঠেস দিয়ে এই একটি কুরচিগাছ তার সমস্ত শক্তিতে বসন্তের জয়ঘোষণা করছে— উপেক্ষিত বসন্তের প্রতি তার অভিবাদন সমস্ত হট্টগোলের উপরে যাতে ছাড়িয়ে ওঠে এই যেন তার প্রাণপণ চেষ্টা । কুরচির সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয়।
ভ্রমর একদা ছিল পদ্মবনপ্রিয় ,
ছিল প্রীতি কুমুদিনী পানে ।
সহসা বিদেশে আসি , হায় , আজ কি ও
কূটজেও বহু বলি মানে!
পদ্মফুলে কে না মুগ্ধ? কিন্তু কুরচিতে? ভ্রমর নাকি পদ্ম ভুলে কুরচির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। সে অপরাধের খাড়া পড়ল কুরচির উপর। অপরাধ তার আরও ছিল বৈ কি! চিরবসন্ত-স্বর্গে মহেন্দ্রের নন্দনকাননে শ্বেতশুভ্র ফুলের প্রতীক ছিল কুরচি। ইন্দ্রাণীর কবরী সজ্জায় সে অপরিহার্য, পারিজাতমঞ্জরির লীলাসঙ্গীও। “পুর্ণিমার অমল চন্দনে” চর্চিত কুরচি আন্দোলিত হত নৃত্যরতা অপ্সরীর মণিবন্ধে। তাকে কিনা এক বেদেনি চুরি করে নিয়ে এল ধূলার ধরায়, আর নাম ভাড়িয়ে লুকিয়ে রাখল ঘরের কানাচে!
শ্বেতভুজা ভারতীয় বীণা এই আভিজাত্যহীনা, নামের গৌরবহারা কুরচিকে অলংকারঝংকারিত কাব্যের মন্দিরে অভ্যর্থনা করে নি। শুভদৃষ্টি ঘটে নি, ঔদাস্যে অবহেলায় তাই কুণ্ঠিতা কুরচি। সে লজ্জায় বিমূঢ় রবীন্দ্রনাথ,
“আমি কবি লজ্জা পাই কবির অন্যায় অবিচারে
হে সুন্দরী। শাস্ত্রদৃষ্টি দিয়ে তারা দেখেছে তোমারে,
রসদৃষ্টি দিয়ে নহে;”
হায়! এ জগতে শাস্ত্রদৃষ্টি কতই না অনাচার ঘটায় ! বেদেনির স্পর্শ কি তবে কুরচিকে অস্পৃশ্য করেছিল? মূল্যহীন তাঁর কাছে রসদৃষ্টি, পোয়েটিক জাস্টিস! কিন্তু কবি সদম্ভে ঘোষণা করেন তাঁর অবস্থান। তাঁর পক্ষপাত কুরচির প্রতিই,
— সংস্কৃত শ্লোকের অনুবাদ
কুরচি , তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা
যে ভ্রমর , শুনি নাকি তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা ।
আমি সেই ভ্রমরের দলে । তুমি আভিজাত্যহীনা ,
নামের গৌরবহারা ; শ্বেতভুজা ভারতীয় বীণা
তোমারে করে নি অভ্যর্থনা অলংকারঝংকারিত
কাব্যের মন্দিরে । তবু সেথা তব স্থান অবারিত ,
বিশ্বলক্ষ্মী করেছেন আ মন্ত্রণ যে প্রাঙ্গণতলে
প্রসাদচিহ্নিত তাঁর নিত্যকার অতিথির দলে ।
আমি কবি লজ্জা পাই কবির অন্যায় অবিচারে
হে সুন্দরী । শাস্ত্রদৃষ্টি দিয়ে তারা দেখেছে তোমারে ,
রসদৃষ্টি দিয়ে নহে ; শুভদৃষ্টি কোনো সুলগনে
ঘটিতে পারে নি তাই , ঔদাস্যের মোহ-আবরণে
রহিলে কুণ্ঠিত হয়ে ।
তোমারে দেখেছি সেই কবে
নগরে হাটের ধারে জনতার নিত্যকলরবে ,
ইঁটকাঠপাথরের শাসনের সংকীর্ণ আড়ালে ,
প্রাচীরের বহিঃপ্রান্তে। সূর্যপানে চাহিয়া দাঁড়ালে
সকরুণ অভিমানে; সহসা পড়েছে যেন মনে
একদিন ছিলে যবে মহেন্দ্রের নন্দনকাননে
পারিজাতমঞ্জরির লীলার সঙ্গিনীরূপ ধরি
চিরবসন্তের স্বর্গে, ইন্দ্রাণীর সাজাতে কবরী;
অপ্সরীর নৃত্যলোল মণিবন্ধে কঙ্কণবন্ধনে
পেতে দোল তালে তালে; পুর্ণিমার অমল চন্দনে
মাখা হয়ে নিঃশ্বসিতে চন্দ্রমার বক্ষোহার-'পরে।
অদুরে কঙ্কররুক্ষ লৌহপথে কঠোর ঘর্ঘরে
চলেছে আগ্নেয়রথ, পণ্যভারে কম্পিত ধরায়
ঔদ্ধত্য বিস্তারি বেগে; কটাক্ষে কেহ না ফিরে চায়
অর্থমূল্যহীন তোমা-পানে, হে তুমি দেবের প্রিয়া,
স্বর্গের দুলালী। যবে নাটমন্দিরের পথ দিয়া
বেসুর অসুর চলে, সেইক্ষণে তুমি একাকিনী
দক্ষিণবায়ুর ছন্দে বাজায়েছ সুগন্ধ-কিঙ্কিণী
বসন্তবন্দনানৃত্যে-- অবজ্ঞিয়া অন্ধ অবজ্ঞারে,
ঐশ্বর্যের ছদ্মবেশী ধূলির দুঃসহ অহংকারে
হানিয়া মধুর হাস্য; শাখায় শাখায় উচ্ছ্বসিত
ক্লান্তিহীন সৌন্দর্যের আত্মহারা অজস্র অমৃত
করেছে নিঃশব্দ নিবেদন।.........

মোর মুগ্ধ চিত্তময়
সেইদিন অকস্মাৎ আমার প্রথম পরিচয়
তোমা-সাথে। অনাদৃত বসন্তের আবাহন গীতে
প্রণমিয়া উপেক্ষিতা, শুভক্ষণে কৃতজ্ঞ এ চিতে
পদার্পিলে অক্ষয় গৌরবে। সেইক্ষণে জানিলাম,
হে আত্মবিস্মৃত তুমি, ধরাতলে সত্য তব নাম
সকলেই ভুলে গেছে , সে নাম প্রকাশ নাহি পায়
চিকিৎসাশাস্ত্রের গ্রন্থে, পণ্ডিতের পুঁথির পাতায়;
গ্রামের গাথার ছন্দে সে নাম হয় নি আজও লেখা,
গানে পায় নাই সুর। সে নাম কেবল জানে একা
আকাশের সূর্যদেব, তিনি তাঁর আলোকবীণায়
সে নামে ঝংকার দেন, সেই সুর ধুলিরে চিনায়
অপূর্ব ঐশ্বর্য তার; সে সুরে গোপন বার্তা জানি
সন্ধানী বসন্ত হাসে। স্বর্গ হতে চুরি করে আনি
এ ধরা, বেদের মেয়ে, তোরে রাখে কুটির-কানাচে
কটুনামে লুকাইয়া, হঠাৎ পড়িস ধরা পাছে।
পণ্যের কর্কশধ্বনি এ নামে কদর্য আবরণ
রচিয়াছে; তাই তোরে দেবী ভারতীর পদ্মবন
মানে নি স্বজাতি বলে, ছন্দ তোরে করে পরিহার--
তা বলে হবে কি ক্ষুণ্ন কিছুমাত্র তোর শুচিতার।
সূর্যের আলোর ভাষা আমি কবি কিছু কিছু চিনি,
কুরচি, পড়েছ ধরা, তুমিই রবির আদরিণী।"
“নগরে হাটের ধারে, জনতার নিত্যকলরবে,
ইঁটকাঠপাথরের শাসনের সংকীর্ণ আড়ালে,
প্রাচীরের বহিঃপ্রান্তে।”
যার অঢেল উপস্থিতি, তাকে নিশ্চই সকলেই ভোলে নি।”জনতার নিত্যকলরবে” কুরচি ঠিকই আছে আপন মহিমায়। তাই থাক না কিছু ভুল ভাল কাব্যকৃতিতে! কতটুকু ক্ষতি তাতে? মূলবাণী পেয়ে গেছি রবীন্দ্রনাথেই। দেবী ভারতীর পদ্মবন স্বজাতি বলে না মানুক, ছন্দ তাকে যতই পরিহার করুক তাতে কুরচির শুচিতা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয় নি। দেবের প্রিয়া, স্বর্গের দুলালী কুরচিকে ঠিকই চিনেছেন সূর্যদেব। কবি তাই নিশ্চিন্ত হন,
“সূর্যের আলোর ভাষা আমি কবি কিছু কিছু চিনি,
কুরচি, পড়েছ ধরা, তুমিই রবির আদরিণী।”
এখানে আবার দেখি সূর্যদেব আর কবি রবি একাকার! কার আদরিণী কুরচি? শুধুই সূর্যদেব রবির, না-কি কবিরও যার নাম রবি?
ভারতবর্ষের আদি নিবাসী কুরচি ক্ষুদ্র আকৃতির বৃক্ষ। কাণ্ড সরল, বাকল অমসৃণ ও হালকা ধূসর রঙের। অজস্র ঊর্ধ্বমুখী শাখায় এলোমেলো। পাতা লম্ব-ডিম্বাকৃতির, মসৃণ এবং উভয়ের বিপরীত দিকে সমভাবে বিন্যস্ত থাকে। শীতে পত্রহীন হয়, ফাল্গুনের শেষভাগে দুয়েক স্তবক ফুল ফুটতে শুরু করে।
ফুল, বাকল ও ফল আমাশয়ের ওষুধ। তাছাড়া ফুল রক্তদোষে, পাতা বাত ও ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসে, বীজ অর্শ্ব ও একজিমায় উপকারী। সর্পদংশন এবং বিছার কামড়েও এ গাছের বাকল ব্যবহার করা হতো। নরম কাঠ থেকে পুতুল ও খেলনা তৈরি হয়।
কুরচির অন্যান্য নাম- কুটজ, ইন্দ্রযব, ইন্দ্রজৌ, বৎসক, কলিঙ্গ, প্রাবৃষ্য, শত্রুপাদপ, সংগ্রাহী, পান্ডুরদ্রুম, মহাগন্ধ, ইংরেজিতে Bitter Oleander, Easter Tree।
আকৃতিতে কামিনীর সাথে বেশ মিল, বর্ণেও। তবু কামিনীর সলাজ ঝরে পড়ার সাথে কুরচির বেমিল নজর কাড়ে। বসন্তে সে প্রস্ফূটনে মাতে, থাকে সমস্ত গ্রীষ্মব্যাপী, বর্ষণসিক্ত হয়ে তার প্রস্ফুটনে যতি। প্রথম পর্বে, বসন্তে শুধুই তুষারধবল কুরচিতে মোড়া নিষ্পত্র তরুটি। দিন যত দীর্ঘতর হয়, উত্তাপ যত বাড়ে, গ্রীষ্মের আগমনে সবুজ পাতা আর সাদা ফুলে লুকোচুরির মনোহরণ দৃশ্য যে দেখে সেই মজে। এদেশে এমন শ্বেত, তুষারধবল ফুলের অক্লান্ত দীর্ঘস্থায়ী প্রস্ফূটনের বন্যা বেশি নেই। কুরচি তাই আমাদের প্রিয় ফুলের তালিকাশীর্ষে স্থান পেতেই পারে।
আমাদের ওঙ্কার ধামের প্রথম কুড়চি গাছটি আমার মায়ের লাগানো , গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় কামিনী ও কুড়চির সুগন্ধি যুগলবন্দী প্রান ভরিয়ে দেয় .........
বসন্তে নিষ্পত্র তরুজুড়ে বরফশুভ্র এমন অনিন্দ্য সুন্দর পুষ্প এ বাংলায় দ্বিতীয়টি নেই।এমন তুষারধবল, প্রস্ফূটনে ক্লান্তিহীন কুরচিকে আমরা আমাদের নাগরিক জীবনে আনন্দের উৎসে পরিণত করতে পারি। আমাদের উদ্যান চর্চায় কেন তবে কুরচি অবহেলিত থাকবে? আসুন, সবাই মিলে এই অপরূপ শ্বেতশুভ্র পুষ্পে ভরে তুলি আমাদের স্বপ্নের বাড়ি,স্বপ্নের নগর,...............

শুক্রবার, ২ জুন, ২০১৭

অনন্তলতা

গুহাযুগ থেকে আজ ,অনন্তকাল ধরে তুমি আছো ,
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ স্নিগ্ধতা নিয়ে,
 হে অনন্তলতা ।
কি আশ্চর্য প্রানসক্তি , অনন্তকাল ধরে  টিকে আছো স্বমহিমায়, তুমি বারবার 
বেঁচে ওঠো ফিনিক্স পাখির মত !
আমাকে চেনা , দেখার  ভালবাসার পর আর
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হয় না আমার,  তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
পুস্পিত করে তুলেছ গুহামানবের গুহা থেকে ,আমার শখের বাগান।
 ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ,
শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন আমার বাগানে
 আমার হাত ছুঁয়ে যাও, তখন আমার মনে হয় এ-শহর, আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতায়,   একটি নীলিমার-ছোঁয়া। ......।
ছবি- কবিতা নাসরিন সৃষ্টি 


আজকের  পপকর্নকে আমরা প্রায় সবাই চিনি , অনন্তলতার রূপসী ফলের দেহে লেখা আছে আধুনিক পপকর্ন আর সনাতন খইয়ের ইতিহাস। প্রত্নত্ত্ববিদরা পপকর্নের যে অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন তা কমপক্ষে ৮০ হাজার বছর আগেকার, অর্থাৎ গুহাবাসীরাও পপকর্নের ব্যবহার জানতো। ৫৬০০ বছর আগেকার মেক্সিকোর বাদুড় অধ্যুষিত গুহায় (Bat Cave) পাওয়া গেছে অনন্তলতার বীজের অস্তিত্ব। প্রাচীনকালে অনন্তলতার খই ছিল এক ধরনের দরকারি খাবার।শুধু খাবার নয়,সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত, নানা রকম চিকিৎসায় বিভিন্ন দেশে (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ঠান্ডাজনিত রোগে) অনন্তলতার  ব্যবহার দেখা যায়।


ছবি - গুগল
 অনন্ত কাল ধরে স্বমহিমায় টিকে আছে অদ্যাবধি, সে কারণে অনন্তলতা। সুন্দর ফুল দেখে যুগে যুগে আবেগী মানুষ লাভ চেইন, লাভ ভাইন, আরো কতো রোম্যান্টিক বিশেষণে ভূষিত করেছে তাকে। যদিও শোভাবর্ধক লতা হিসাবে এর খুব একটা জনপ্রিয়তা নেই। আমাদের  সখের বাগানে খুব একটা চোখে পড়ে না। বরং আগাছা হিসাবেই এর পরিচিতি বেশি। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে আগাছা হিসেবে এরা চরম আকার ধারণ করেছে। অস্ট্রেলিয়া, ফ্লোরিডাতে চিহ্নিত হয়েছে আগ্রাসী আগাছা (Exotic Pest Control Council, Florida) হিসেবে। আদিবাস মেক্সিকো থেকে সারা দুনিয়াতে এই গাছ ছড়িয়েছে কচুরি পানার মতো। প্রচন্ড মৃত্তিকা ও বায়ু দূষণের মধ্যেও বছর বছর ধরে বহাল তবিয়তে টিকে থাকে এরা। যে কোন গাছকে জড়িয়ে, পাঁচিল বা বাড়ির ছাদে অনন্তলতা অহরহ দেখা যায়। লতানো স্বভাবের হওয়ায় যে কোনো বাহন পেলেই অনেকদূর অবধি উঠতে পারে। প্রস্ফুটন প্রাচুর্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সব ধরনের বাগানেই এ গাছ আদর্শ। তাছাড়া বিশেষ উদ্যানশৈলীর ক্ষেত্রেও বিভিন্ন নকশায় এ গাছ উপস্থাপন করা যায়।

   গ্রীষ্মকালের শুরু থেকে তবে থাকে বর্ষা-শরত্ অবধি,থেকে যায় অনন্তলতার ফুল ফোটার  রেশ । পাঁচটি পাঁপড়ি যুক্ত। ফুলের রূপ সহজে ম্লান হয় না।ফুল দেখতে ছোট হলেও বৃত্যাংশ বড় হয়।ফুলের আদল অনেকটা বাগানবিলাস বা বগেনভলিয়ার মত, তবে অনেকটাই  ছোটো , অনেকেই বৃত্যাংশকেই ফুল বলে ভুল করে থাকে। অন্যান্য দেশে এর প্রকারভেদ থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণত সাদা ও গাঢ় লাল বা গোলাপি রঙের ফুল দেখা যায়। গোলাপি রঙের ফুলের বৃত্যাংশ পাঁচটি ও রঙিন।

একটু দূর থেকে গাছ দেখে মনে হয়, গাছে বুঝি ফল ধরে না। অথচ সারা গাছে ধরে থাকে ৪-৬ মিলিমিটারের ছোটো ছোটো  ফল দেখতে অনেকটা আমাদের ছেলেবেলায় খেলা লাট্টুর মতো । ফলগুলি লুকিয়ে থাকে ফুলের ৫ পাঁপড়ির নিচে, খানিকটা ভাঁট ফুল ও ফলের মতো ।
ছবি - কবিতা নাসরিন সৃষ্টি

 এর বংশবিস্তার সাধারনত বীজ ও কন্দ থেকে হয়। বীজগুলো জলে ভাসে, ভেসে চলে যায় দূরে। ডাঙ্গার দেশে পাখিরা খায়, হরিণ, ছাগল জাতীয় তৃণভোজী প্রাণী ও বাদুর জাতীয় প্রাণীরও খাদ্য। খাবারের মাধ্যমে বীজ চলে যায় আরেক জায়গায়। গাছ ধ্বংস হয়ে গেলেও আগুন লেগে ছাই হয়ে যায় চারদিক কিন্তু গাছের নিচের কন্দ আর সাকার-রুট (Succer Root) থেকে নতুন করে জন্ম হয় অক্ষয় অনন্তলতার।