রবিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৭

উদ্ভিদের ইন্দ্রিয় ও ভালোবাসা

ইদানিং অনুভবে বুঝতে পারি ,আমার গাছের সাথে আমার একটা আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছে যেটা যা শুধুই ছিল আমার সন্তান তিতলির সাথে। আমি খুব গভীরভাবে ভাবতে পারিনা , তবে আমার অনূভুতি দিয়ে বুঝি ভালোবাসার স্পর্শে আমার গাছ পাতা হেসে ওঠে, আমি রোজ একবার হলেও গাছের সাথে দেখা করি, কথা বলি । হয়ত ভাবছেন গাছের সাথে কথা বলা, এ আবার কেমন পাগলামি, গাছ কি আর আমাদের কথা বুঝতে পারে? আমার মনে হয় , শুনেছেন কখনও পায়ের তলায় চাপা পরে যাওয়া ঘাসগুলোর কান্নাভেজা কাকতি মিনতি, আমায় মাড়িয়ে যেওনা ।বাগানের কোনে ঐ যে পলাশ গাছটি দেখা যাচ্ছে ওটা কি ঘ্রান নিতে পারে? বা ওই যে গাদা ফুল গাছটি ওর কি আদৌ দৃষ্টি ক্ষমতা আছে? কখনো কখনো মনে হয় , আমি আসতে আসতে পাগল হয়ে যাচ্ছি বোধহয় !


এই কথাগুলি আমার ও বিশ্বাস হয়, গাছ ও ভালবাসতে পারে ,ভালোলাগা,আনন্দ,কস্ট সব আছে । কীভাবে পারে তা বিজ্ঞান আমাদের জানিয়ে দিয়েছে স্পষ্টভাবে,বাংলার কৃতী সন্তান, বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু দেখিয়েছেন মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মত গাছেরও অনুভূতি আছে। নিজের আবিষ্কৃত cresograph নামক যন্ত্রের সাহায্যে তিনি প্রমান করতে সক্ষম হয়েছেন মানুষের মত গাছও ব্যাথা অনুভব করে। আমরা যখন গাছের পাতা ছিঁড়ি কখনও কি ভেবেছি গাছের ভেতর কি অনুভূত হচ্ছে? তিনি দেখিয়েছেন যখন গাছের পাতা ছেঁড়া হয় তখন যে জায়গায় ছেঁড়া হল সেখানে সংবেদনশীলতা (impulse) কিছুক্ষনের জন্য থেমে যায়। আবার সংবেদন শুরু হয় তবে এবার খুব ধীরে এবং কিছুক্ষন পর তা পুরোপুরি থেমে যায়।
তিনি আরও দেখিয়েছেন বিশেষ শব্দ তরঙ্গ (যেমন শ্রুতিমধুর সঙ্গীত) গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অপরদিকে উচ্চ বা কর্কশ শব্দ গাছের বৃদ্ধি প্রতিহত করে। পরবর্তীতে ১৯৬০ দশকের দিকে Dr. Cleve Backster ও একই ধরনের ফলাফল অবহিত করেন। তিনি গাছের পাতার সাথে পলিগ্রাফ (lie detector) যন্ত্র সংযোগ করে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে গাছের বদ্যুতিক তরঙ্গের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। গাছের পাতাকে যখন গরম কফিতে চুবানো হোল পলিগ্রাফের রিডিং কমতে থাকল যেটা হতাশা আর দুঃখের নির্দেশক। অতঃপর তিনি গাছের পাশে দাড়িয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে গাছে আগুন লাগানোর অভিপ্রায় ভাবতে লাগলেন, তখন পলিগ্রাফ রিডিং হঠাৎ করে বেড়ে গেল। যেন গাছ মানুষের আভিপ্রায় বোঝার ক্ষমতা রাখে। ১৯৬২ সালের দিকে ভারতের আন্নামালিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক Dr. T. C. Singh দোপাটি ফুলের উপর সঙ্গীতের প্রভাব পরিক্ষা করে দেখান ক্লাসিকাল এবং রাগ সঙ্গিতের প্রভাবে গাছের বৃদ্ধি এবং ফলন বেশি হয় । তিনি আরও দেখিয়েছেন পিটুনিয়া এবং গাদা ফুল গাছ যখন ভারত নাট্টৈম জাতীয় নাচের কম্পনের সংস্পর্শে আনা হয় তখন গাছগুলোর ফুল দুই সপ্তাহ আগে ফোটে। ১৯৭৩ সালের দিকে Dorothy Retallack বেশ কয়েকটি গাছ নিয়ে ভিন্ন সঙ্গীত প্রয়োগ করেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন rock music গাছকে অস্বাভাবিক লম্বা আর পাতাগুলো ছোট করে দেয়। কলা গাছকে rock music শোনানোর ফলে গাছ গুলো মারা যায় । উনার এই সব তথ্য উনি The Sound of Music and Plants (1973) নামক বইয়ে প্রকাশ করেছেন । Country music গাছের বৃদ্ধির উপর কোন প্রভাব ফেলেনি। Jazz music শোনানোর ফলে গাছের বৃদ্ধি ভাল হয়েছিল।
গাছের ইন্দ্রিয় র কথা বলতে গিয়ে জগদীশ চন্দ্র তাঁর 'অব্যক্ত ' প্রবন্ধে গাছের জন্ম মৃত্যু ও অনুভবের কথা লিখেছিলেন , প্রবন্ধটির কিছুটা অংশ উল্লেখ করলাম ----
গাছের কথা
গাছেরা কি কিছু বলে? অনেকে বলিবেন, এ আবার কেমন প্রশ্ন? গাছ কি কোনো দিন কথা কহিয়া থাকে? মানুষেই কি সব কথা ফুটিয়া বলে? আর যাহা ফুটিয়া বলে না, তাহা কি কথা নয়? আমাদের একটি খোকা আছে, সে সব কথা ফুটিয়া বলিতে পারে না; আবার ফুটিয়া যে দুই চারিটি কথা বলে, তাহাও এমন আধো আধো ও ভাঙা ভাঙা যে, অপরের সাধ্য নাই তাহার অর্থ বুঝিতে পারে। কিন্তু আমরা আমাদের খোকার সকল কথার অর্থ বুঝিতে পারি। কেবল তাহা নয়। আমাদের খোকা অনেক কথা ফুটিয়া বলে না; চক্ষু, মুখ ও হাত নাড়া, মাথা নাড়া প্রভৃতির দ্বারা আকার ইঙ্গিতে অনেক কথা বলে, আমরা তাহাও বুঝিতে পারি, অন্যে বুঝিতে পারে না। একদিন পার্শ্বের বাড়ি হইতে একটি পায়রা উড়িয়া আসিয়া আমাদের বাড়িতে বসিল; বসিয়া গলা ফুলাইয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিল। পায়রার সঙ্গে খোকার নূতন পরিচয়; খোকা তাহার অনুকরণে ডাকিতে আরম্ভ করিল। 'পায়রা কি-রকম ভাবে ডাকে?' বলিলেই ডাকিয়া দেখায়; তদ্‌ভিন্ন সুখে দুঃখে, চলিতে বসিতে, আপনার মনেও ডাকে। নূতন বিদ্যাটা শিখিয়া তাহার আনন্দের সীমা নাই।
একদিন বাড়ি আসিয়া দেখি, খোকার বড়ো জ্বর হইয়াছে; মাথার বেদনায় চক্ষু মুদিয়া বিছানায় পড়িয়া আছে। যে দুরন্ত শিশু সমস্ত দিন বাড়ি অস্থির করিয়া তুলিত, সে আজ একবার চক্ষু খুলিয়াও চাহিতেছে না। আমি তাহার বিছানার পাশে বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলাম। আমার হাতের স্পর্শে খোকা আমাকে চিনিল, এবং অতি কষ্টে চক্ষু খুলিয়া আমার দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিল। তার পর পায়রার ডাক ডাকিল। ঐ ডাকের ভিতর আমি অনেক কথা শুনিলাম। আমি বুঝিতে পারিলাম, খোকা বলিতেছে, 'খোকাকে দেখিতে আসিয়াছ? খোকা তোমাকে বড়ো ভালোবাসে।' আরও অনেক কথা বুঝিলাম, যাহা আমিও কোনো কথার দ্বারা বুঝাইতে পারি না।
যদি বল, পায়রার ডাকের ভিতর এত কথা কি করিয়া শুনিলে? তাহার উত্তর এই, খোকাকে ভালোবাসি বলিয়া। তোমরা দেখিয়াছ, ছেলের মুখ দেখিয়া মা বুঝিতে পারেন ছেলে কি চায়। অনেক সময় কথারও আবশ্যক হয় না। ভালোবাসিয়া দেখিলেই অনেক গুণ দেখিতে পাওয়া যায়, অনেক কথা শুনিতে পাওয়া যায়।
আগে যখন একা মাঠে কিংবা পাহাড়ে বেড়াইতে যাইতাম, তখন সব খালি-খালি লাগিত। তার পর গাছ, পাখি, কীট পতঙ্গদিগকে ভালোবাসিতে শিখিয়াছি, সে অবধি তাদের অনেক কথা বুঝিতে পারি, আগে যাহা পারিতাম না। এই যে গাছগুলি কোনো কথা বলে না, ইহাদের আবার একটা জীবন আছে, আমাদের মতো আহার করে, দিন দিন বাড়ে, আগে এ সব কিছুই জানিতাম না। এখন বুঝিতে পারিতেছি। এখন ইহাদের মধ্যেও আমাদের মতো অভাব, দুঃখ-কষ্ট দেখিতে পাই। জীবনধারণ করিবার জন্য ইহাদিগকেও সর্বদা ব্যস্ত থাকিতে হয়। কষ্টে পড়িয়া ইহাদের মধ্যেও কেহ কেহ চুরি ডাকাতি করে। মানুষের মধ্যে যেরূপ সদ্‌গুণ আছে, ইহাদের মধ্যেও তাহার কিছু কিছু দেখা যায়। বৃক্ষদের মধ্যে একে অন্যের সাহায্য করিতে দেখা যায়, ইহাদের মধ্যে একের সহিত অপরের বন্ধুতা হয়। তার পর মানুষের সর্বোচ্চ গুণ যে স্বার্থত্যাগ, গাছে তাহাও দেখা যায়। মা নিজের জীবন দিয়া সন্তানের জীবন রক্ষা করেন। সন্তানের জন্য নিজের জীবন-দান উদ্ভিদেও সচরাচর দেখা যায়। গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়ামাত্র। ক্রমে এ সব কথা তোমাদিগকে বলিব।
তোমরা শুষ্ক গাছের ডাল সকলেই দেখিয়াছ। মনে কর, কোনো গাছের তলাতে বসিয়াছ। ঘন সবুজ পাতার গাছটি ঢাকা, ছায়াতে তুমি বসিয়াছ। গাছের নীচে এক পার্শ্বে একখানি শুষ্ক ডাল পড়িয়া আছে। এক সময় এই ডালে কত পাতা ছিল, এখন সব শুকাইয়া গিয়াছে, আর ডালের গোড়ায় উই ধরিয়াছে। আর কিছুকাল পরে ইহার চিহ্নও থাকিবে না। আচ্ছা, বলো তো এই গাছ আর এই মরা ডালে কি প্রভেদ? গাছটি বাড়িতেছে, আর মরা ডালটা ক্ষয় হইয়া যাইতেছে; একে জীবন আছে, আর অন্যটিতে জীবন নাই। যাহা জীবিত তাহা ক্রমশ বাড়িতে থাকে। জীবিতের আর একটি লক্ষণ এই যে, তাহার গতি আছে, অর্থাৎ তাহারা নড়ে চড়ে। গাছের গতি হঠাৎ দেখা যায় না। লতা কেমন করিয়া ঘুরিয়া গাছকে জড়াইয়া ধরে, দেখিয়াছ?
জীবিত বস্তুতে গতি দেখা যায়; জীবিত বস্তু বাড়িয়া থাকে। কেবল ডিমে জীবনের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। ডিমে জীবন ঘুমাইয়া থাকে। উত্তাপ পাইলে ডিম হইতে পাখির ছানা জন্মলাভ করে। বীজগুলি যেন গাছের ডিম; বীজের মধ্যেও এরূপ গাছের শিশু ঘুমাইয়া থাকে। মাটি, উত্তাপ ও জল পাইলে বীজ হইতে বৃক্ষশিশুর জন্ম হয়।
বীজের উপর এক কঠিন ঢাক্‌না; তাহার মধ্যে বৃক্ষ-শিশু নিরাপদে নিদ্রা যায়। বীজের আকার নানাপ্রকার, কোনোটি অতি ছোটো, কোনোটি বড়ো। বীজ দেখিয়া গাছ কত বড়ো হইবে বলা যায় না। অতি প্রকাণ্ড বটগাছ, সরিষা অপেক্ষা ছোটো বীজ হইতে জন্মে। কে মনে করিতে পারে, এত বড়ো গাছটা এই ক্ষুদ্র সরিষার মধ্যে লুকাইয়া আছে? তোমরা হয়তো কৃষকদিগকে ধানের বীজ ক্ষেতে ছড়াইতে দেখিয়াছ। কিন্তু যত গাছপালা, বন-জঙ্গল দেখ, তাহার অনেকের বীজ মানুষ ছড়ায় নাই। নানা উপায়ে গাছের বীজ ছড়াইয়া যায়। পাখিরা ফল খাইয়া দূর দেশে বীজ লইয়া যায়। এই প্রকারে জনমানবশূন্য দ্বীপে গাছ জন্মিয়া থাকে। ইহা ছাড়া অনেক বীজ বাতাসে উড়িয়া অনেক দূর দেশে ছড়াইয়া পড়ে। শিমুল গাছ অনেকে দেখিয়াছ। শিমুল-ফল যখন রৌদ্রে ফাটিয়া যায় তখন তাহার মধ্য হইতে বীজ তুলার সঙ্গে উড়িতে থাকে। ছেলেবেলায় আমরা এই সকল বীজ ধরিবার জন্য ছুটিতাম; হাত বাড়াইয়া ধরিতে গেলেই বাতাস তুলার সহিত বীজকে অনেক উপরে লইয়া যাইত। এই প্রকারে দিন-রাত্রি দেশ-দেশান্তরে বীজ ছড়াইয়া পড়িতেছে।
প্রত্যেক বীজ হইতে গাছ জন্মে কি না, কেহ বলিতে পারে না। হয়তো কঠিন পাথরের উপর বীজ পড়িল, সেখানে তার অঙ্কুর বাহির হইতে পারিল না। অঙ্কুর বাহির হইবার জন্য উত্তাপ, জল ও মাটি চাই।
যেখানেই বীজ পড়ুক না কেন, বৃক্ষ-শিশু অনেক দিন পর্যন্ত বীজের মধ্যে নিরাপদে ঘুমাইয়া থাকে। বাড়িবার উপযুক্ত স্থানে যতদিন না পড়ে, ততদিন বাহিরের কঠিন ঢাক্‌না গাছের শিশুটিকে নানা বিপদ হইতে রক্ষা করে।
ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বীজ পাকিয়া থাকে। আম, লিচুর বীজ বৈশাখ মাসে পাকে; ধান, যব ইত্যাদি আশ্বিন কার্তিক মাসে পাকিয়া থাকে। মনে কর, একটি গাছের বীজ আশ্বিন মাসে পাকিয়াছে। আশ্বিন মাসের শেষে বড়ো ঝড় হয়। ঝড়ে পাতা ও ছোটো ছোটো ডাল ছিঁড়িয়া চারিদিকে পড়িতে থাকে। এইরূপে বীজগুলি চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। প্রবল বাতাসের বেগে কোথায় উড়িয়া যায়, কে বলিতে পারে? মনে কর, একটি বীজ সমস্ত দিন-রাত্রি মাটিতে লুটাইতে লুটাইতে একখানা ভাঙা ইট কিংবা মাটির ডেলার নীচে আশ্রয় লইল। কোথায় ছিল, কোথায় আসিয়া পড়িল। ক্রমে ধূলা ও মাটিতে বীজটি ঢাকা পড়িল। এখন বীজটি মানুষের চক্ষুর আড়াল হইল। আমাদের দৃষ্টি হইতে দূরে গেল বটে, কিন্তু বিধাতার দৃষ্টির বাহিরে যায় নাই। পৃথিবী মাতার ন্যায় তাহাকে কোলে তুলিয়া লইলেন। বৃক্ষ-শিশুটি মাটিতে ঢাকা পড়িয়া বাহিরের শীত ও ঝড় হইতে রক্ষা পাইল। এইরূপে নিরাপদে বৃক্ষ-শিশুটি ঘুমাইয়া রহিল।
উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু
মৃত্তিকার নীচে অনেক দিন বীজ লুকাইয়া থাকে। মাসের পর মাস এইরূপে কাটিয়া গেল। শীতের পর বসন্ত আসিল। তারপর বর্ষার আরম্ভে দুই-এক দিন বৃষ্টি হইল। এখন আর লুকাইয়া থাকিবার প্রয়োজন নাই। বাহির হইতে কে যেন শিশুকে ডাকিয়া বলিতেছে, 'আর ঘুমাইয়ো না, উপরে উঠিয়া আইস, সূর্যের আলো দেখিবে।' আস্তে আস্তে বীজের ঢাক্‌নাটি খসিয়া পড়িল, দুইটি কোমল পাতার মধ্য হইতে অঙ্কুর বাহির হইল। অঙ্কুরের এক অংশ নীচের দিকে গিয়া দৃঢ়রূপে মাটি ধরিয়া রহিল, আর এক অংশ মাটি ভেদ করিয়া উপরে উঠিল। তোমরা কি অঙ্কুর উঠিতে দেখিয়াছ? মনে হয় শিশুটি যেন ছোটো মাথা তুলিয়া আশ্চর্যের সহিত নূতন দেশ দেখিতেছে।
গাছের অঙ্কুর বাহির হইলে যে অংশ মাটির ভিতর প্রবেশ করে, তাহার নাম মূল। আর যে অংশ উপরের দিকে বাড়িতে থাকে, তাহাকে বলে কাণ্ড। সকল গাছেই 'মূল' আর 'কাণ্ড' এই দুই ভাগ দেখিবে। এই এক আশ্চর্যের কথা, গাছকে যেরূপেই রাখ, মূল নীচের দিকে ও কাণ্ড উপরের দিকে যাইবে। একটি টবে গাছ ছিল। পরীক্ষা করিবার জন্য কয়েক দিন ধরিয়া টবটিকে উল্টা করিয়া ঝুলাইয়া রাখিলাম। গাছের মাথা নীচের দিকে ঝুলিয়া রহিল, আর শিকড় উপরের দিকে রহিল। দুই-এক দিন পরে দেখিতে পাইলাম যে, গাছ যেন টের পাইয়াছে। তাহার সব ডালগুলি বাঁকা হইয়া উপরের দিকে উঠিল ও মূলটি ঘুরিয়া নীচের দিকে নামিয়া গেল। তোমরা অনেকে শীতকালে অনেক বার মূলা কাটিয়া শয়তা করিয়া থাকিবে। দেখিয়াছ, প্রথমে শয়তার পাতাগুলি ও ফুল নীচের দিকে থাকে। কিছুদিন পরে দেখিতে পাওয়া যায়, পাতা ও ফুলগুলি উপর দিকে উঠিয়াছে।
আমরা যেরূপ আহার করি, গাছও সেইরূপ আহার করে। আমাদের দাঁত আছে, আমরা কঠিন জিনিস খাইতে পারি। ছোটো ছোটো শিশুদের দাঁত নাই; তাহারা কেবল দুধ খায়। গাছেরও দাঁত নাই, সুতরাং তাহারা কেবল জলীয় দ্রব্য কিংবা বাতাস হইতে আহার গ্রহণ করিতে পারে। মূল দ্বারা মাটি হইতে গাছ রস শোষণ করে। চিনিতে জল ঢালিলে চিনি গলিয়া যায়। মাটিতে জল ঢালিলে মাটির ভিতরের অনেক জিনিস গলিয়া যায়। গাছ সেই সব জিনিস আহার করে। গাছের গোড়ায় জল না দিলে গাছের আহার বন্ধ হইয়া যায়, ও গাছ মরিয়া যায়।
অনুবীক্ষণ দিয়া অতি ক্ষুদ্র পদার্থ দেখিতে পাওয়া যায়। গাছের ডাল কিংবা মূল এই যন্ত্র দিয়া পরীক্ষা করিলে দেখা যায় যে, গাছের মধ্যে হাজার হাজার নল আছে। এইসব নল দ্বারা মাটি হইতে গাছের শরীরে রস প্রবেশ করে।
এ ছাড়া গাছের পাতা বাতাস হইতে আহার সংগ্রহ করে। পাতার মধ্যে অনেকগুলি ছোটো ছোটো মুখ আছে। অণুবীক্ষণ দিয়া এই সব মুখে ছোটো ছোটো ঠোঁট দেখা যায়। যখন আহার করিবার আবশ্যক হয় না তখন ঠোঁট দুইটি বুজিয়া যায়। আমরা যখন শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করি তখন প্রশ্বাসের সঙ্গে এক প্রকার বিষাক্ত বায়ু বাহির হইয়া যায়; তাহাকে অঙ্গারক বায়ু বলে। ইহা যদি পৃথিবীতে জমিতে থাকে তবে সকল জীবজন্তু অল্পদিনের মধ্যে এই বিষাক্ত বায়ু গ্রহণ করিয়া মরিয়া যাইতে পারে। বিধাতার করুণার কথা ভাবিয়া দেখ। যাহা জীবজন্তুর পক্ষে বিষ, গাছ তাহাই আহার করিয়া বাতাস পরিষ্কার করিয়া দেয়। গাছের পাতার উপর যখন সূর্যের আলোক পড়ে, তখন পাতাগুলি সূর্যের তেজের সাহায্যে অঙ্গারক বায়ু হইতে অঙ্গার বাহির করিয়া লয়। এই অঙ্গার গাছের শরীরে প্রবেশ করিয়া গাছকে বাড়াইতে থাকে। গাছেরা আলো চায়, আলো না হইলে ইহারা বাঁচিতে পারে না। গাছের সর্বপ্রধান চেষ্টা, কি করিয়া একটু আলো পাইবে। যদি জানালার কাছে টবে গাছ রাখ, তবে দেখিবে, সমস্ত ডালগুলি অন্ধকার দিক্‌ ছাড়িয়া আলোর দিকে যাইতেছে। বনে যাইয়া দেখিবে, গাছগুলি তাড়াতাড়ি মাথা তুলিয়া কে আগে আলোক পাইতে পারে, তাহার চেষ্টা করিতেছে। লতাগুলি ছায়াতে পড়িয়া থাকিলে আলোর অভাবে মরিয়া যাইবে, এইজন্য তাহারা গাছ জড়াইয়া ধরিয়া উপরের দিকে উঠিতে থাকে।
এখন বুঝিতে পারিতেছ, আলোই জীবনের মূল। সূর্যের কিরণ শরীরে ধারণ করিয়াই গাছ বাড়িতে থাকে। গাছের শরীরে সূর্যের কিরণ আবদ্ধ হইয়া আছে। কাঠে আগুন ধরাইয়া দিলে যে আলো ও তাপ বাহির হয়, তাহা সূর্যেরই তেজ। গাছ ও তাহার শস্য আলো ধরিবার ফাঁদ। জন্তুরা গাছ খাইয়া প্রাণ ধারণ করে; গাছে যে সূর্যের তেজ আছে তাহা এই প্রকারে আবার জন্তুর শরীরে প্রবেশ করে। শস্য আহার না করিলে আমরাও বাঁচিতে পারিতাম না। ভাবিয়া দেখিতে গেলে, আমরাও আলো আহার করিয়া বাঁচিয়া আছি।
কোনো কোনো গাছ এক বৎসরের পরেই মরিয়া যায়। সব গাছই মরিবার পূর্বে সন্তান রাখিয়া যাইতে ব্যগ্র হয়। বীজগুলিই গাছের সন্তান। বীজ রক্ষা করিবার জন্য ফুলের পাপড়ি দিয়া গাছ একটি ক্ষুদ্র ঘর প্রস্তুত করে। গাছ যখন ফুলে ঢাকিয়া থাকে, তখন কেমন সুন্দর দেখায়। মনে হয়, গাছ যেন হাসিতেছে। ফুলের ন্যায় সুন্দর জিনিস আর কি আছে? গাছ তো মাটি হইতে আহার লয়, আর বাতাস হইতে অঙ্গার আহরণ করে। এই সামান্য জিনিস দিয়া কি করিয়া এরূপ সুন্দর ফুল হইল? গল্পে শুনিয়াছি, স্পর্শমণি নামে এক প্রকার মণি আছে, তাহা ছোঁয়াইলে লোহা সোনা হইয়া যায়। আমার মনে হয়, মাতার স্নেহই সেই মণি। সন্তানের উপর ভালোবাসাটাই যেন ফুলে ফুটিয়া উঠে। ভালোবাসার স্পর্শেই যেন মাটি এবং অঙ্গার ফুল হইয়া যায়।
গাছে ফুল ফুটিয়া রহিয়াছে দেখিলে আমাদের মনে কত আনন্দ হয়! বোধ হয় গাছেরও যেন কত আনন্দ! আনন্দের দিনে আমরা দশজনকে নিমন্ত্রণ করি। ফুল ফুটিলে গাছও তাহার বন্ধু-বান্ধবদিগকে ডাকিয়া আনে। গাছ যেন ডাকিয়া বলে 'কোথায় আমার বন্ধু-বান্ধব, আজ আমার বাড়িতে এসো। যদি পথ ভুলিয়া যাও, বাড়ি যদি চিনিতে না পার, সেজন্য নানা রঙের ফুলের নিশান তুলিয়া দিয়াছি। এই রঙিন পাপড়িগুলি দূর হইতে দেখিতে পাইবে।' মৌমাছি ও প্রজাপতির সহিত গাছের চিরকাল বন্ধুতা। তাহারা দলে দলে ফুল দেখিতে আসে। কোনো কোনো পতঙ্গ দিনের বেলায় পাখির ভয়ে বাহির হইতে পারে না। পাখি তাহাদিগকে দেখিলেই খাইয়া ফেলে। কাজেই রাত্রি না হইলে তাহারা বাহির হইতে পারে না। সন্ধ্যা হইলেই তাহাদিগকে আনিবার জন্য ফুল চারি দিকে সুগন্ধ বিস্তার করে।
গাছ ফুলের মধ্যে মধু সঞ্চয় করিয়া রাখে। মৌমাছি ও প্রজাপতি সেই মধু পান করিয়া যায়। মৌমাছি আসে বলিয়া গাছেরও উপকার হয়। ফুলে তোমরা রেণু দেখিয়া থাকিবে। মৌমাছিরা এক ফুলের রেণু অন্য ফুলে লইয়া যায়। রেণু ভিন্ন বীজ পাকিতে পারে না।
এইরূপে ফুলের মধ্যে বীজ পাকিয়া থাকে। শরীরের রস দিয়া গাছ বীজগুলিকে লালনপালন করিতে থাকে। নিজের জীবনের জন্য এখন আর মায়া করে না। তিল তিল করিয়া সন্তানের জন্য সমস্ত বিলাইয়া দেয়। যে শরীর কিছু দিন পূর্বে সতেজ ছিল, এখন তাহা একেবারে শুকাইয়া যাইতে থাকে। শরীরের ভার বহন করিবারও আর শক্তি থাকে না। আগে বাতাস হু-হু করিয়া পাতা নড়াইয়া চলিয়া যাইত। পাতাগুলি বাতাসের সঙ্গে খেলা করিত; ছোটো ডালগুলি তালে তালে নাচিত। এখন শুষ্ক গাছটি বাতাসের ভর সহিতে পারে না। বাতাসের এক-একটি ঝাপ্‌টা লাগিলে গাছটি থর-থর করিয়া কাঁপিতে থাকে। একটি একটি করিয়া ডালগুলি ভাঙিয়া পড়িতে থাকে। শেষে একদিন হঠাৎ গোড়া ভাঙিয়া গাছ মাটিতে পড়িয়া যায়।
এইরূপে সন্তানের জন্য নিজের জীবন দিয়া গাছ মরিয়া যায়।"
গাছের দর্শনানুভুতি ঃ-
আমাদের চোখে যেমন আলোক সংবেদনশীল প্রোটিন (photoreceptor proteins) আছে গাছেও তেমনি আছে আলোক সংবেদনশীল প্রোটিন। গাছের ডালের অগ্রভাগের কোষ গুলোতে phototropin নামক প্রটিন বিদ্যমান থাকে। এই ফটোট্রপিন নীল রশ্মি অনুভব করে সাংকেত ধারার (signal cascade) সৃষ্টি করে যা আক্সিন নামক হরমনের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে। অক্সিনের সক্রিয়তার ফলে ডালের যে পাশে ছায়া থাকে সে পাশের কোষ গুল প্রলম্বিত হয় ফলে ডালটি আলোর দিকে ধাবিত হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে গাছও দেখতে পায়।
গাছের স্পর্শানুভুতি ঃ-
স্পৃশ্য জগতে বৃক্ষের বসবাস। ডালপালা বাতাসে দোল খায়, পোকামাকড় পাতার উপর হেঁটে বেড়ায়, লতা অবলম্বনের সন্ধানে চারিদিক খুজে বেড়ায়। বৃক্ষের স্পর্শ বোধ তুলে ধরার জন্য ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ একটা ভাল উদাহারন। জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব উর্জবার্গের বিজ্ঞানীরা উদ্ঘাটন করেছেন ভয়ঙ্কর এ গাছটি সম্পর্কে নতুন একটি তথ্য। তারা জানান, ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের চুলটানা রেখার পাতায় যখন কোনো পোকা স্পর্শ করে তখন ফ্লাইট্র্যাপ স্পর্শগুলো গুণতে পারে। এরা বুঝতে পারে যার স্পর্শ পেলো তা ভোজ্য উপকরণ নাকি মিথ্যা সংকেত। ফলে যখন এক, দুই, তিন করে পাঁচবার কোনো উদ্দীপক অর্থাৎ, কীটপতঙ্গ তার পাতায় স্পর্শ করে তখন সে উদ্দীপকের উপর পাচক রস ক্ষরণ করে শুষে নেয় ও অবশিষ্টাংশ ফেলে দেয়।যখন কোন পোকামাকড় পাতারুপী ফাঁদের সংবেদনশীল রোম (trigger hair) গুলোকে স্পর্শ করে তখন সূচালো কাটাগুলো চট করে খাঁজে খাঁজে আবদ্ধ হয়ে শিকারটিকে আটকিয়ে ফেলে। ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ যে প্রক্রিয়াতে তার শিকারকে অনুভব করে তা হাতের ওপর মাছির উপস্থিতি উপলব্ধি করার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আমাদের চর্মে অবস্থিত Touch receptors গুলো মাছির উপস্থিতিতে বৈদ্যুতিক চাপ উৎপন্ন করে যা নার্ভের মাধ্যমে মস্তিস্কে পৌঁছে। মস্তিস্ক তখন রেস্পন্স সিগন্যাল পাঠায়। ফলে আমরা মাছিটাকে তাড়িয়ে দেই। অনুরুপ ভাবে যখন কোন পোকা ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপের রোমগুলোর সংস্পর্শে আসে তখন পাতায় উৎপন্ন বৈদ্যুতিক চাপ পাতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাতাকে দ্রুত বন্ধ করে দেয়।
গাছের গন্ধ অনুভুতি ঃ-
দেখা যাক এবার গাছ কিভাবে গন্ধ নেয়। স্বর্নলতাকে উদ্ভিদ জগতের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গন্ধ সনাক্তকারী কুকুরের সাথে তুলনা করা যায়। পরজিবী বিধায় স্বর্নলতাকে খাবারের জন্য অন্য উদ্ভিদের উপর জন্মাতে হয়। গাছটি গন্ধ শুঁকে আশ্রয়ী উদ্ভিদকে খুজে বের করে এবং বৈরী উদ্ভিদ থেকে দূরে থাকে। স্বর্নলতা গন্ধের ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল। অন্যান্য উদ্ভিদ এত সংবেদনশীল না হলেও কম বেশি সংবেদনশীল। প্রানীকুলে নাকের গন্ধসংবেদনশীল কোষ গুলো বাতাসে বাহিত এরমা অণুগুলো সনাক্ত করতে পারে। গাছে গন্ধ সংবেদনশীল রেসেপটার (receptor) আছে যারা বাতাসের উদ্বায়ী গন্ধ অণুগুলোকে সনাক্ত করতে পারে। ১৯২০ সালের দিকে USDA এর বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন ইথাইলিন (ethylene) গ্যাস কিভাবে ফলের পাক ধরাতে সহায়তা করে। ফল পাকার সময় ঘনিয়ে এলে ফল এই গ্যাস নির্গত করে নিজে পাকে এবং পাশবর্তী ফলকে পাকায় । Ethylene একটি উদ্ভিদ হরমোন যেটা ফল পাকানোর পাশাপাশি আরও কিছু কাজ করে থাকে। হেমন্তে গাছের পাতার রঙ বদলানো তার মধ্যে অন্যতম। গন্ধ নির্গত করে গাছ শত্রুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে এবং যোগাযোগ বজায় রাখে।
গাছের স্বাদ অনুভুতি ঃ-
এবার স্বাদের কথায় আসা যাক। স্বাদ এবং গন্ধ মিলে মিশে খাবারের প্রতি আমাদের রুচিকে প্রভাবিত করে। আমরা যখন খাবার চিবাই তখন সাথে সাথে খবারের গন্ধও পাই। স্বাদ ভাল হলেও যদি গন্ধ ভাল না হয় আমরা খেতে অনীহা দেখাই। স্বাদ ও গন্ধের মধ্যে মুলগত পার্থক্য হল স্বাদ তরল পদার্থকে সনাক্ত করে আর গন্ধ করে উদ্বায়ী পদার্থকে। মিথাইল জেসমনেট (methyl jasmonate) নামক একটি রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে স্বাদের ব্যাপারটা বোঝানর চেষ্টা করা যাক। এই গ্যাসটি যখন পত্ররন্ধ্রের (stomata) মধ্য দিয়ে বিস্তৃত হয় তখন এটা দ্রবণীয় জেসমনিক এসিডে (Jasmonic acid) রূপান্তরিত হয়। এই জেস্মনিক এসিড কোষের রেছেপটর (receptor) অনুগুলোকে উদ্দিপ্ত করে গাছের প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলে। স্বাদের কথা বলতে গেলে শেকড়ের কথা না বললেই নয়। গাছ শেকরের সাহায্যে মাটি থেকে দ্রবণীয় খাবার গ্রহন করে থাকে। যেহেতু কোন দ্রব্যের স্বাদ অনুভব করতে দ্রব্যটির তরল অবস্থায় রুপান্তর আবশ্যক তাই যৌক্তিক ভাবে বলা যায় যে গাছের স্বাদ অনভুতির অনেকখানিই শিকড়ে বিরাজমান । পরীক্ষা করে দেখা গেছে গাছের কোন এক সারিতে যখন খরার সৃষ্টি করা হয় তখন আশ্চর্যযনক ভাবে এই গাছ গুলোর অনতিদূরে অবস্থিত গাছ গুলোর পত্ররন্ধ্র (stomata) বন্ধ হয়ে যায়। খরা আক্রান্ত গাছগুলো অনতিদুরবর্তী গাছ গুলোর শিকড়ে দ্রবণীয় সঙ্কেত পাঠিয়ে গাছগুলোর পত্ররন্ধ্র বন্ধ করে দিয়ে গাছের জলীয় ভাগের অপচয় হ্রাস করে। খরায় বেঁচে থাকার এই সুনিপুণ কৌশল কি বলে দেয়না যে গাছও একটি বুদ্ধিদীপ্ত জীব।
গাছের শ্রবনানুভুতি ঃ-
গাছের শ্রবণ শক্তিও বেশ প্রখর! শব্দ তরঙ্গ দ্বারা গাছ নিজেদের মধ্যে সংকেত আদান প্রদান করে। সুইজারল্যান্ড এর Institute of Plant Science এর বিজ্ঞানীরা খরার সময় পাইন এবং ওক গাছ থেকে বিচ্ছুরিত শব্দ কম্পন রেকর্ড করেছেন। তাদের ধারণা এই শব্দ কম্পন দ্বারা গাছ নিকটবর্তী অন্যান্য গাছ গুলোকে খরার সংকেত দিয়ে আসছে। University of Missouri থেকে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন ক্যাটারপিলার গাছের পাতা খাওয়ার সময় যে শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে ঠিক সেরকম শব্দ তরঙ্গ যদি কৃত্রিম ভাবে গাছকে প্রেরন করা হয় তাহলে ঐ গাছগুলোতে কীটনাশক রাসায়নিক দ্রব্যের আধিক্য দেখা দেয় । অন্যদিকে যে গাছগুলোকে এই শব্দ তরঙ্গ দেয়া হয় নাই সেগুলোতে ঐ রাসায়নিক পদার্থের কোন পরিবর্তন হয় না। তাদের অভিমতে এই বিশেষ শব্দ তরঙ্গ গাছের এক বিশেষ রেসেপটার (receptor) দ্বারা সনাক্ত হয়ে গাছের defense mechanism কে সক্রিয় করে কীটনাশক পদার্থের সৃষ্টি করে। বিষাক্ত রাসায়নিক কীটনাশক ব্যাবহারের পরিবর্তে আমরা এমন একটা পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সচেষ্ট হতে পারি যেখানে কৃত্রিম উপায়ে এই শব্দ তরঙ্গ ক্ষেতের ফসলে প্রয়োগ করে পোকার আক্রমন থেকে ফসলকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। আর গাছের সঙ্গীতপ্রীতি আমরা এই প্রবন্ধের শুরুতে আলোকপাত করেছি।
গাছ প্রতিনিয়ত পত্র মেলে, ফূল ফুটিয়ে আর ফল ধরিয়ে আমাদের অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে যায়, মনকে উজ্জীবিত করে,মন খুশি তে ভরিয়ে দেয়,ভালবাসতে শেখায়, গাছর ছোঁয়াতেই হয়ত কিছুটা হলেও দুঃখকষ্ট, শোক ভুলে থাকা যায়।
ফুলের রঙের বাহারে রুপে,গন্ধে আমরা মুগ্ধ হই কিন্তু কখনও হয়ত ভাবিনি এই নিরীহ বৃক্ষরাজিরও একটা অনভুতির জগৎ আছে।প্রকৃতপক্ষে গাছের এই অনুভুতি তার বেঁচে থাকার জন্যই হয়ত জরুরী । গাছ শিকড় দিয়ে মাটি আঁকড়ে পরে থাকে। এরা খাদ্যের সন্ধানে হেঁটে বেড়াতে পারেনা, দৌড়ে পালিয়ে মানুশ,পশুপক্ষী ও পঙ্গপাল এবং অন্যান্য পোকামাকড় হাত থেকে বাঁচতেও পারে না। তবু আমি বিশ্বাস করি সব গাছেরই চোখ, কান, নাক, মুখ এবং চর্ম না থাকলেও গাছেরও যে আমাদের মতই নিজস্ব ইন্দ্রিয় আছে।
আগেই বলেছি সুযোগ পেলেই নিঝুম দুপুরে বাগানে বসে আমি আমার অনুভব দিয়ে আমার গাছের সাথে কথা বলি । আর রাতে আমার ছাদে একটু হলেও সময় কাটাই ওদের সাথে ...।। যখন তিতলির জন্য বুকটা হু হু করে ওঠে তখন অনুভব করি ,আমার তিতলি মায়ের প্রিয় গাছেরা মাথা দুলিয়ে ফিসফিস করে বলে , 'কাঁদছ কেন, আমরা তো আছি '.....😢😢🍀🥀🌺🌺🥀🥀
তথ্য সহায়তা --ভাত্রিপ্রতিম অধ্যাপক অর্নিবান মিত্র ও জনাব মহবুব চৌধুরী ।
গ্রন্থঋন -- How Acharya Jagadish Chandra Bose proved plants have life 115 years ago
জগদীশ রচনা ও প্রবন্ধাবলী

সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৭

বিদেশী ফুলের গুচ্ছ / Bidesi Phulera Guccha

ফুল ও গাছ ভালোবাসেন না এমন মানুষ সত্যি ই বিরল ।এই নিয়ে আমার একটা মজার গল্প বলি ।
আগেই বলেছি আমাদের বাড়ি 'অঙ্কার ধাম' এর বাগান সেই বাবার আমল থেকে, ছোটবেলা থেকে ফুল আর পাখিদের মধ্যেই বড় হয়েছি। ৭৭ কি ৭৮ সাল হবে , আমার মাসির বিয়ে হল , মাসি ও নতুন মেসোমশায় আমাদের বাড়িতে এসেছেন , অত্যন্ত ভদ্র মানুষ, সরকারী চাকুরি করেন । বাবা অফিসে , ছুটির দিন ,বাগানে ঘোরাঘুরি করছি ,মেসোমশাই ঘুরে ঘুরে বাগান দেখছেন , আমাকে বললেন , ""আচ্ছা এত ফুলগাছ, তোমরা কি গাছ বিক্রি কর " ? আমি বললাম না না ,এ সবই শখের ,সৌন্দর্যের জন্য ,( প্রসঙ্গত জানাই ,তখন পাড়ায় পাড়ায় এত নার্সারীর চল ছিল না) । আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নতুন মেসোমশাই বললেন ," সুন্দর ! টাকার চেয়ে সুন্দর জিনিষ আর কিছু হয় না। এ সব গাছ বিক্রির চেষ্টা কর ,তাতে ভালো হবে , না হলে এভাবে সময় নস্ট করে কোনো লাভ নেই" 😀😁😁
আমি হতভম্ব !!! আমি এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি !!! আজ এই প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে সেই অদ্ভুত মানুষটার কথা মনে পরায় এই 'ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেললাম' ।
যুগ যুগ ধরে 'শক হুন দল পাঠান মোঘল' দের ও বিভিন্ন বিদেশী বনিক ও সবুজপ্রেমীদের হাত ধরে নানা গাছ ও ফুল এসেছে 'সুজলা সুফলা শস্য স্যামলা' আমাদের এই বাংলায় ।অনুকূল ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুর সুবাদে বাংলা একটি উদ্ভিদসমৃদ্ধ অঞ্চল। অধিকন্তু হিমালয়, বর্মা-মালয় ও পূর্ব-ভারতের উদ্ভিদজগতের মিলনস্থল বিধায় এখানে প্রজাতির সংখ্যা ও বৈচিত্র্য অনেক। যুগ যুগ ধরে এমন সমৃদ্ধ প্রকৃতির মাঝখানে বসবাসকারী বাংলার মানুষ স্বভাবতই উদ্ভিদঘনিষ্ঠ ও পুষ্পপ্রেমিক, আর সেই সাক্ষ্য আছে বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্য, লোকগাথা ও লোকগীতিতে, এমনকি তাম্রলিপিতেও। হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগে পূজা-অর্চনার জন্য ফুলের যোগান দিতে নিশ্চিতই বাগান ছিল গৃহাঙ্গন ও মন্দিরে, ধ্যানার্থীর তপোবনে এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য রাজন্য ও অভিজাতদের প্রাসাদে। এসব ফুলের সবই ছিল দেশজ ও বনজ। আজও আমাদের পাহাড় ও বনাঞ্চলে অনেক প্রজাতির ফুল আছে যেগুলি বাগানে লাগানো যায়। তবে মুগলরাই ভারতে প্রথম সংগঠিত ও নির্দিষ্ট নকশার উদ্যানরীতি প্রবর্তন করেন। তারাই এদেশে আনেন মধ্যপ্রাচ্যের গাছপালা (চিনার, গোলাপ, লিলি ইত্যাদি)। ঔপনেবিশক শাসনামলে পাশ্চাত্য প্রভাবাধীন হওয়ায় এদেশে মুগলশৈলীর উদ্যানের কোন বিবর্তন আর ঘটে নি। আজও ভারতীয় উদ্যান বলতে মুগল উদ্যানই বোঝায়।
এদেশের বাগানের গাছপালার সিংহভাগই বিদেশী। এগুলি এনেছেন রাজা-বাদশা, পরিব্রাজক, বণিক, উপনিবেশিক শাসক ও তাদের কর্মচারীরা। এদেশের বাগানের ফুলগুলির মধ্যে মায়ানমার ও মালয় ছাড়া আছে চীন, জাপান, আফ্রিকা ও ক্রান্তীয় আমেরিকার বহু প্রজাতি। পরিচিতির সুবিধার্থে এগুলিকে বৃক্ষ, গুল্ম, লতা, কন্দীয়-মূলীয় ও মৌসুমি ঔষধিতে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়।
বৃক্ষ পুষ্পবৃক্ষ সাধারণত লাগানো হয় পার্ক, বড় বাগান, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যালয়ের চত্বরে। সুশ্রী পাতা, রঙিন প্রস্ফুটন ও মধুর গন্ধের জন্য এগুলি আকর্ষণীয়। উল্লেখযোগ্য বৃক্ষ: শিরীষ (Albizia lebbek, Parrot tree), ছাতিম (Alstonia scholaris, Devit’s tree), কদম (Anthocphalus chinensis, Kadamba), দেবকাঞ্চন (Bauhinia purpurea, Mountain ebony), রক্তকাঞ্চন (B. variegata, Purple orchid tree), শিমুল (Bombax ceiba, Red silk-cotton tree), পলাশ (Butea monosperma, Flame of the forest), বটলব্রাস (Callistemon citrinus), সোনালু সোনাইল/কর্ণিকার (Cassia fistula, Indian laburnum), লাল সোনাইল (C. javanica), মিনজিরি (C. siamea, Kassod tree), নাগলিঙ্গম (Couroupita guianensis, Cannonball tree), বরুণ (Crataeva nurvala, Caper tree), কৃষ্ণচূড়া (Delonix regia, Peacock flower), গ্লিরিসিডিয়া (Gliricidia sepium, Madre D’caeae), কুরচি/কূটজ/গিরিমল্লিকা (Holarrhena antidysenterica, Easter flower), জারুল (Lagerstroemia speciosa, Pride of India, Queen of flowers), বিলাতী জারুল (L. thorellii), হিমচাঁপা/উদয়পদ্ম (Magnolia grandifloara, Laural magnolia), নাগেশ্বর (Mesua nagassarium, Ironwood tree), স্বর্ণচাপা (Michelia champaca, Golden champa), বকুল (Mimusops elengi, Indian medlar), শেফালী (Nyctanthes arbor-tristis, Coral jasmine), পেল্টোফরাম (Peltophorum pterocarpum, Rusty shield bearer), কাঠগোলাপ/গৌরচাঁপা/গোলকচাঁপা, গোলাচি (Plumeria spp., Frangipani), অশোক (Saraca asoca), কলকে (Thevetia peruviana, Yellow oleander)।
এগুলি ছাড়াও অনেক বাগানে দেখা যায় অপেক্ষাকৃত কিছু দুষ্প্রাপ্য প্রজাতি: Amherstia nobilis (Tree of Heaven), Brownea coccinea (Scarlet flame bean), পুন্নাগ/সুলতান চাঁপা (Calophyllum inophyllum, Aleksandrian laurel), স্কারলেট কর্ডিয়া (Cordia sebenstena, Scarlet cordia), গুস্তাভিয়া (Gustavia augusta, Stink wood), পলকজুঁই Ixora paviflora, Torch tree), জ্যাকারান্ডা (Jacaranda mimosifolia, Jacaranda), মিলেসিয়া (Milletia peguensis, Jewels on a string), আকাশনীম/হিমঝুরি (Millingtonia hortensis, Indian cork tree), কনকচাঁপা/রামধনচাঁপা (Ochna squarrosa, Ramdhan champa), রুদ্রপলাশ (Spathodea companulata, African tulip tree), পরশপিপুল (Thespesia populnea, Portia tree)।
গুল্ম এগুলি গোড়া থেকে শাখায়িত, সাধারণত চিরসবুজ ও বহুবর্ষজীবী, ছোট-বড় সবধরণের বাগানেই লাগানো হয়। বাগান সজ্জার এই প্রধান উপকরণগুলির মধ্যে আছে: শিবঝুল/শিবজটা (Acalypha hispida, Cat’s tail), ঘণ্টাফুল (Allamanda nerifolia), ঝিন্টি কুরুবক (Barleria cristata Philipine violet), স্বর্ণঝিন্টি (B. prionitis), কাঞ্চন (Bauhinia acuminata, Orchid tree), রাধাচূড়া (Caesalpina pulcherrima, Peacock flower), হাসনাহেনা (Cestrum nocturnum, Queen of the night), ধুতরা (Datura fastuosa, Thorn apple), লালপাতা (Euphorbia pulcherrima, Poinsettia, Christmas flower), পাতাবাহার (Codiaeum variegatum, croton), গন্ধরাজ (Gardenia jasminoides, Cape Jasmine), জবা (Hibiscus rosa-sinensis, Chinarose), স্থলপদ্ম (H. mutabilis, Changable rose), লাল রঙ্গন (Ixora coccinea), হলুদ রঙ্গন (I. lutea), গোলাপী রঙ্গন (I. rosea), সিঙ্গাপুরী রঙ্গন (I. singapurensis), কুন্দ (Jasminum pubescens), বেলী (J. sambae, Arabian jasmine), ফুরুস (Lagerstroemia indica, Crape myrtle), গুয়েগাঁদা (Lantana camara), লঙ্কা জবা (Malvaviscus arboreus), সন্ধ্যামালতী/সন্ধ্যামণি (Mirabilis jalapa, Marvel of peru), কামিনী (Murrya exotica, Chinese box), নাগবল্লী (Mussaenda frondosa, M. erythrophylla, M. lutela), রক্তকরবী (Nerium oleander, Oleander), গোলাপ (Rosa spp.), টগর (Tabernaemontana coroneria, Cape jasmine), নয়নতারা (Vinca rosea, Periwinkle).
অপেক্ষাকৃত দুষ্প্রাপ্য গুল্মের মধ্যে রয়েছে: লাল ঘণ্টাফুল (Allamanda violocea), ছোট ঘণ্টাফুল (A, shottie), ব্রুনফেলসিয়া (Brunfelsia calycina, Yesterday-today-tomorrow), কেলিস্টেমন (Callistemon brevipes, C. haematocephata), রাজঘন্টা (Datura suaveoleus, Angel’s trumpet), ডম্বিয়া (Dombya mastersii), ঝুমকা জবা (Hibiscus schizopetalous, Coral hibiscus), নীল জবা (H. syriacus, Rose of sharon), স্বর্ণচামেলী (Jasminum humile, Yellow jasmine), জেট্রফা (Jatropha panduraefolia), জহুরি চাঁপা (Magnolia pumila), দাঁতরাঙ্গা/লুটকি (Melastoma malabathricum, Indian rhododendron), অঞ্জন (Memecylon umbellata, Red iron wood), নীল চিতা (Plumbago auriculata, Cape leadwort), রন্ডেলেসিয়া (Rondeletia odorata), রাসেলিয়া (Russelia juncea, Coral plant), সোনাপাতি (Tecoma gaudichandi, T. stans, Yellow bell), নীল ঘণ্টা (Thunbergia erecta)।
লতা এগুলির অধিকাংশই বহুবর্ষজীবী, কান্ড দুর্বল বিধায় নিজেই কিংবা অাঁকশি, কাঁটা ইত্যাদি উপাঙ্গের সাহায্যে আশ্রয় জড়িয়ে উপরে ওঠে। এগুলি মাটিতে তেমন জায়গা দখল করে না বলে ছোট বাগানেও বেশি সংখ্যায় লাগানো যায়। দালান, ফটক, বেড়া ইত্যাদিতে লতা বহুল ব্যবহূত। এগুলির অনেক প্রজাতি রঙিন ফুল ও অন্যগুলি সুগন্ধি প্রস্ফুটনের জন্য আকর্ষণীয়। লতানো গোলাপ ও বাগানবিলাসের এজন্য বিশেষ সমাদর। বাগানের সাধারণ লতার মধ্যে আছে: মালতী লতা (Aganosma dichotoma), হলুদ ঘণ্টাফুল/হরকাকরা (Allamanda cathartica), অনন্তলতা (Antigonon leptopus), কাঁঠালী চাঁপা (Artabotrys odoratissimus, Climbing ylangylang), বাগানবিলাস (Bougainvillea glabra, B. peruviana, B. spectabitis), ট্রাম্পেট ক্লাইম্বার (Campsis grandiflora, Trumpet climber), ব্লিডিং হার্ট (Clerodendrum thomsonae, Bleeding heart), অপরাজিতা (Clitoria ternatea, Mussel-shell climber), উলটচন্ডাল (Gloriosa superba, Glory lily), ভাদ্রা (Gmelina hystrix), মাধবীলতা (Hiptage benghalensis, চন্দ্রমুখী, দুধিয়া লতা (Ipomea abla, Moon flower), রেললতা (I. palmata, Railway creeper), মর্নিংগ্লোরি (I. Indica, Morning glory), জুঁই (Jasminum auriculatum), চামেলী J. grandifloram, Spanish jasmine), যূথিকা (J. offiinale, White jasmine), হ্যানিস্যাকল (Lonicera japonica, Japanese honeysuckle), ঝুমকা লতা (Passiflora caerulea, Passion flower), নীলমণি লতা (Petrea volubilis, Purple wreath), লতা পারুল (Psendocalyma alliaceum, Garlic vine), গোল্ডেন শাওয়ার (Pyrostegia venusta), তারামণি লতা, কুঞ্জলতা (Quamoclit pinnata, Cypress vine), মধুমালতী/মধুমঞ্জরি লতা Quisqualis indica, Rangoon creeper).
কন্দজ এগুলি সাধারণত বহুবর্ষজীবী, সচরাচর শীতে মরে যায় ও বসন্ত-গ্রীষ্মে আবার গজায়। কোন কোনটির ফুল খুবই আকর্ষণীয়, কোনটি বা সুগন্ধি। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: বেলেডনা লিলি (Amaryllis belladona), লেপার্ড লিলি (Belamcanda chinensis, Leopard flower), কলাবতী/সর্বজয়া (Canna indica), সুখদর্শন (Crinum bulbispernum, Cape lily), ইউকারিস লিলি (Eucharis amazonica), গ্লাডিওলাস (Gladiolus spp.), ফায়ারবল লিলি (Haemanthus multiflorus, Fireball lily), দোলনচাঁপা (Hedyechium coronerium), স্পাইডার লিলি (Hymenocallis littoralis, Spider lily), ভুঁইচাঁপা (Kaempferia ratunda), রজনীগন্ধা (Polianthes tuberosa, Tuberose), ঘাসফুল (Zephyranthes spp., Zephyr lily).
মৌসুমি ফুল এগুলি সাধারণত শীতের শুরুতেই চাষ করা হয়, কোন কোনটি বর্ষায়ও। শীতের বিবর্ণ প্রকৃতিতে নানা রং ছড়ায় বলে এগুলির বিশেষ সমাদর। অধিকাংশই বিদেশী। এগুলির মধ্যে আছে: অ্যাজিরাটাম (Ageratum maxicana, Floss flower), হলিহক (Althaea rosea, Hollyhock), অ্যান্টারিনাম (Antirrhinum majus, Snapdragon), ক্যালান্ডুলা (Calendula officinalis, Pot marigold), অ্যাস্টার (Callistephus chinensis, Aster), মোরগ ফুল (Celosia argentea, Cockscomb), কর্ন ফ্লাওয়ার (Centaurea cyanus, Cornflower), সুইট সুলতান (C. moschata, Sweet sultan), চন্দ্রমল্লিকা (Chrysanthemum spp), ক্যারিওপসিস (Coreopsis drummondii, Calliopsis), কসমস (Cosmos bipinnatus, Cosmos), বর্ষাতি কসমস (C. sulphureus, Summer cosmos), ডালিয়া (Dahlia variabilis, Dahlia), লার্কস্পার (Dalphinium ajacis, Larkspur), সুইট উইলিয়ম (Dianthus barbatus, Sweet willian), কার্নেসন (D. caryophyllus, Carnation), পিংক (D. chimnensis, Indian pink), গ্যালার্ডিয়া (Gaillardia pulchella, Blanket flower), সূর্যমুখী (Helianthus annuus, Sunflower), বোতাম ফুল (Gomphrena globosa, Globe amaranta), স্ট্র ফ্লাওয়ার Helichrysum bracteatum, Strawflower), দোপাটি (Impatiens balsamina, Balsam), মর্নিংগ্লোরি (Ipomea rubrocaerulea, Marning glory), সুইট পি (Lathyrus odoratus, Sweet pea), লবেলিয়া (Lobelia erinus, Lobelia), লুপিন (Lupinus spp, Lupin), পপি (Papaver rhoeas, Corn popy), পেটুনিয়া (Petunia hybrida, Petunia), ফ্লক্স (Phlox drummondii, Phlox), পর্তুলেকা (Portulaea grandiflora, Rose moss), স্যালভিয়া (Salvia coccinea, Sage), গাঁদা (Tagetes erecta, African marigold), কালী গাঁদা (T. patula, French marigold), ন্যাস্টারসিয়াম (Tropaeolum majas, Nasturtium), ভার্বেনা (Verbena hybrida, Verbena), পেন্সি (Viola tricolor hortensis, Viola), জিনিয়া (Zinnia elegans, Zinnia)।
প্রাকৃতিক নিয়মে তরুপ্রজাতি প্রতিনিয়তই স্থান বদলায়। সুদূর আফ্রিকা কিংবা লাতিন আমেরিকার কোনো গাছ আমাদের দেশে এসেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। আবার আমাদের অঞ্চলের কোনো গাছ অস্ট্রেলিয়ায় প্রাকৃতিক বৃক্ষ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। এ কারণেই গাছপালাকে নির্দিষ্ট কোনো ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ করা যায় না। সমগ্র পৃথিবী তার আবাসস্থল। তাই সবধরনের গাছপালাকেই সমগুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখতে হয়। নানাভাবে আমাদের দেশে এসে থিতু হওয়া বিদেশি গাছগুলোকে দেশি নাম দিয়ে বরণ করা উচিত। রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বিভিন্ন শ্রুতিমধুর নাম দিয়ে অনেক বিদেশি গাছপালাকে আপন করে নিয়েছেন। পেট্টিয়া’র নাম রেখেছেন নীলমণিলতা, রেঙ্গুনক্রিপারের নাম মধুমঞ্জরি লতা, মিলিংটোনিয়ার নাম হিমঝুরি, 'অ্যাডেনিয়াম' এর বাংলা নাম ‘কিন্নরী’,পাসসিফ্লরা এর নাম ঝুমকোলতা, এমন আরও কিছু গাছকে তিনি বাংলা নাম দিয়ে আদৃত করেছেন।
আরো কিছু বিদেশী গাছের নাম দিয়েছেন বিভিন্ন কবি, লেখক ও সবুজপ্রেমীরা । যেমন, আফ্রিকান টিউলিপ এর বাংলা নাম রুদ্রপলাশ,ক্রেব/ফুরুস এর বাংলা নাম ফুল্লরা,পয়েন্সেটিয়ার বাংলা নাম অগ্নিপত্রা, ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা\ উদয়পদ্ম, .স্কারলেট কর্ডিয়া\রক্ত্ররাগ, পুটুশ-ছত্রা/ল্যান্টানা,মর্নিং গ্লোরী \ভোরের-রানী, লিসিএন্থাস\ নন্দিনী, হোয়াইট বাটারফ্লাই পিএ(সাদা অপারাজিতা) মহাশ্বেতা ...
ইত্যাদি কিন্তু তারপর এক বিরাট শূন্যতা! বছরের পর বছর ধরে অনেক বিদেশি গাছ আমাদের দেশে এসে থিতু হয়েছে, অথচ তাদের কোনো বাংলা নাম নেই। ফলে শুরু হয়েছে বিভ্রান্তি। একেকজন একক নামে চেনেন। এই সুযোগে গাছ বিক্রেতারাও রাতারাতি নামের কারিগর সেজে বসেছে। ক্রেতাদের সামনে ভুল-ভাল নামে উপস্থাপন করছে বিভিন্ন বিদেশি গাছ। এসব বিদেশি গাছপালা সংখ্যায় নেহায়েৎ কম নয়।
এমন কয়েকটি বিদেশি গাছের নাম এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না;, গ্লিরিসিডিয়া, মিলেশিয়া, জ্যাকারান্ডা, কমব্রেটামলতা, অ্যালমান্ডা, ইউক্যালিপটাস, ইপিল ইপিল, ব্রনফেলসিয়া, অ্যারোকেরিয়া, ক্যাশিয়া সায়ামিয়া, ক্যাশিয়া জাভানিকা, ক্যামেলিয়া, গুস্তাভিয়া, গোল্ডেন শাওয়ার, গ্ল্যাডিওলাস, ট্যাবেবুইয়া, ট্রাম্পিট লতা, পেটুনিয়া, পেল্টোফরাম টেরোকার্পাম, বটলব্রাশ, মানিপ্ল্যান্ট, ল্যান্টানা, সাইকাস, স্কারলেট কর্ডিয়া ইত্যাদি। উদ্ভিদবিজ্ঞানী, কবি, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে নামকরণের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তাহলে বিদেশি গাছের নাম নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না।
বাগান করতে গেলে যে প্রশ্ন সবার প্রথমে মনে আসে,কখন কি গাছ লাগাবো,কখন কি ফুল ফোটে >? আমি আমার মতো করে বিভিন্ন মরশুমে ফোটা ফুলের একটি চিত্র দেবার চেস্টা করলাম ।
১. সারা বছর ফোটে এমন ফুলঃ
(ক) লতানোঃ অপরাজিতা, কাঁঠালীচাঁপা, কেশরাজ, মর্নিংগ্লোরি, মুসেন্ডা
(খ) বীরুৎঃ নয়নতারা, সন্ধ্যামালতী
(গ) গুল্মঃ কুন্দ, করবী, গোলাপ, গন্ধরাজ, জবা , ঝাঁটি, ঝুমকো জবা, টগর, ধুতুরা, নীল ঘন্টা, বেলী, মেহেদী, মল্লিকা, রঙ্গন, লঙ্কাজবা, লুটকি, শিবজটা, হাস্নাহেনা
(ঘ) বৃক্ষঃ বটলব্রাশ
২. ফেব্রুয়ারী থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) লতানোঃ নীলমণিলতা, মাধুরীলতা
(খ) বীরুৎঃ কলাবতী
(গ) গুল্মঃ ক্যামেলিয়া, গোকুল
(ঘ) বৃক্ষঃ অশোক, কাঠবাদাম, পারিজাত, পারুল, পিয়াল, পলাশ, বকুল, মুচকুন্দ, শিমুল
৩. এপ্রিল থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) লতানোঃ গন্ধভাদালী, চামেলী, ঝুমকো, লবঙ্গলতা
(খ) বীরুৎঃ দোপাটি, ভূঁইচাঁপা, লিলি, কালো বাসক
(গ) গুল্মঃ কাঁটা মেহেদী, ডালিম, সুরভী
(ঘ) বৃক্ষঃ উদয়পদ্ম, ক্যাসিয়া, কনকচাঁপা, কলকে, কৃষ্ণচূড়া, গাব, গামারী, গুলাল, ঘোড়া নীম, জারুল, তেলশুর, নীম, পাদাউক, পেল্টোফোরাম, বরুণ, শিরীষ, সোনালু, লাল সোনাইল
৪. জুন থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) লতানোঃ উলটচণ্ডাল, কুঞ্জলতা, জুঁই, মাধবীলতা
(খ) বীরুৎঃ দোলনচাঁপা, দুপুরচণ্ডী, রজনীগন্ধা
(গ) গুল্মঃ কাঞ্চন, কেয়া, ঘেঁটু, নীলজবা, ফুরুস, রাধাচূড়া, লান্টানা, শ্বেত অতসী
(ঘ) বৃক্ষঃ কামিনী, কদম, চাঁপা, নাগেশ্বর, নাগলিঙ্গম
৫. অগাস্ট থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) বীরুৎঃ মোরগ ফুল
(খ) গুল্মঃ ঘন্টাফুল, স্থলপদ্ম
(গ) বৃক্ষঃ শিউলি
৬. অক্টোবর থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) বীরুৎঃ অতসী
(খ) বৃক্ষঃ কাঞ্চন, ছাতিম, হিজল
৭. ডিসেম্বর থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) লতানোঃ অনন্তলতা, বাগানবিলাস
(খ) বীরুৎঃ গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, অ্যাস্টার, কসমস, জিনিয়া, ডালিয়া, পিটুনিয়া, পর্টুলেকা, ফ্লক্‌স, ভার্বেনা, লার্কস্পার, সুইট পি, সালভিয়া, হলিহক
(গ) গুল্মঃ বকফুল
(ঘ) বৃক্ষঃ কুড়চি
গত কয়েক বছর ধরেই চলছে উন্নয়নের নামে বৃক্ষ নিধন উৎসব , ছায়া সুনিবিড় নির্জন রাস্তা বদলে যাচ্ছে ঝাঁ চকচকে হাই ওয়ে তে । আজকের কেরিয়ারিস্ট ছেলেমেয়েদের কাছে গাছ ফুল নিয়ে এই সব আলোচনা , কিছু নিস্কর্মা বোকা,হাফ পাগল লোকের কাজ ।
কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখি জানেন,এই ঝাঁ চকচকে রাস্তার দুই ধার বর্ণে গন্ধে উজ্জ্বল হয়ে আছে, পলাশ,কুরচি,জাকারান্ডা,লাল সোনাইল,কনকচুড়া,শিমুল,রাধাচুড়া, স্বর্ণচাঁপা ,অশোক, গুলমোহর ,হিজল প্রভৃতি গাছে ।
আপনি একবার কল্পনায় ভেবে দেখুন। আপনার চোখের সামনে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পথ। তার দু’পাশে থরে থরে সাজানো জারুল, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়া। বিন্যাসটা এমন যে প্রথমে কৃষ্ণচূড়া, তারপর সোনালু, সোনালুর পর জারুল; এভাবেই তৈরি করা হয়েছে তিন রঙের সুসজ্জিত বীথি। জারুলের রঙ উজ্জ্বল বেগুনি, সোনালুর রঙ হলুদ, সোনালি আর কৃষ্ণচূড়ার প্রধান রঙ টকটকে লাল। এমন সৌন্দর্য থেকে কি চোখ ফেরানো যায়? চোখটা সরিয়ে নিলেও মনটা কিন্তু পড়েই থাকবে সেখানে। আর সেখানেই যদি হয় আমাদের পুষ্প উৎসব, তাহলে কেমন হয়। আমরা এমন একটি পুষ্প উৎসবের স্বপ্ন দেখছি দীর্ঘদিন। এমন একটি স্বপ্ন দেখা কি অবান্তর কারণ গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে ছড়ানো থাকে যাবতীয় উন্মাদনার রঙ। কৃষ্ণচূড়ার রঙ পাগল করা। অনেকদূর থেকেই তার উজ্জ্বল রঙ আমাদের উতলা করে। জাপানে শুধু চেরি ফুল ফোটার মৌসুমে ওরা প্রতিবছর মস্তবড় উৎসব করে। ওদের একটিই তো ফুল; আর আমাদের আমাদের বৃক্ষবৈচিত্র্য : নতুন ভাবনা
তিন তিনটি প্রধান ফুল। তাহলে কেন আমরা বঞ্চিত হচ্ছি এমন একটি নান্দনিক উৎসব থেকে। আমাদের দেশে এই ধরনের একটি অ্যাভিনিউ তৈরি করা কি খুব ব্যয়বহুল? মোটেই না, অতি সহজ। আমাদের অনেক সড়ক আছে, যার দু’পাশ এখনো বৃক্ষ ও ছায়াহীন। এমন একটি সড়কই বেছে নিতে পারি। হতে পারে কলকাতার অদূরে কিংবা অনেক দূরে। আবার নতুন কোনো সড়কও হতে পারে। পর্যায়ক্রমে রেল সড়কের পাশেও এমন বর্ণচ্ছটা তৈরি করা যেতে পারে। এমন একটি পুষ্প বিন্যস্ত পথকে ঘিরে প্রাথমিক পর্যায়ে উৎসবটি হতে পারে দু’দিনব্যাপী।
আমি ১০০% আশাবাদী একদিন আমাদের এই বাংলার প্রতিটা রাস্তা,রেল সড়কের দুই ধার সেজে উঠবে ফুলে,ফলে , হয়ত সেদিন আমি থাকব না ,তবু ,.........
" আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।
হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে।
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।"
গ্রন্থঋন --
Green Nature, Each Flower Is A Word, - Dwijen Sharma