"কশ্চিত্ কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারাত্প্রমত্তঃ
শাপেনাস্তঙ্গমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেণ ভর্তুঃ .
যক্ষশ্চক্রে জনকতনযাস্নানপুণ্যোদকেষু
স্নিগ্ধচ্ছাযাতরুষু বসতিং রামগির্যাশ্রমেষু ..
তস্মিন্নদ্রৌ কতিচিদবলাবিপ্রযুক্তঃ স কামী
নীত্বা মাসান্ কনকবলযভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠঃ .
আষাঢস্য প্র(শ)থমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীডাপরিণতগজপ্রেক্ষণীযং দদর্শ ..
তস্য স্থিত্বা কথমপি পুরঃ কৌতুকাধানহেতোঃ
অন্তর্বাষ্পশ্চিরমনুচরো রাজরাজস্য দধ্যৌ .
মেঘালোকে ভবতি সুখিনোঽপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ
কণ্ঠাশ্লেষপ্রণযিনি জনে কিং পুনর্দূরসংস্থে ..
প্রত্যাসন্নে নভসি দযিতাজীবিতালম্বনার্থী
জীমূতেন স্বকুশলমযীং হরযিষ্যন্ প্রবৃত্তিম্ .
স প্রত্যগ্রৈঃ কুটজকুসুমৈঃ কল্পিতার্ঘায তস্মৈ
প্রীতঃ প্রীতিপ্রমুখবচনং স্বাগতং ব্যাজহার .. " মেঘদুতম ( Meghaduuta
Kalidasa’s Cloud Messenger)
হিমালয় পর্বতের মানস সরোবরের সন্নিকটে অলকাপুরী নামে এক মনোরম রাজ্য ছিল। তার অধিপতি কুবের। এদের বলা হতো দেবতা [আসলে মানুষ]। স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সুখী। সেই কুবের রাজার এক কর্মচারী যক্ষ একদিন বাগান পাহারার কাজে অবহেলা করেছিল। সেই অপরাধে তাকে এক বছরের জন্য নির্বাসন দিয়ে পাঠিয়ে দিল বিন্ধ্য পর্বতের রামগিরিতে। ওদিকে ঘরে, একাকিনী প্রিয়া। নির্বাসনে আট মাস কোনোমতে কেটে গেল। এসে গেছে বর্ষা। মৌসুমি মেঘ চলেছে উত্তর দিকে হিমালয়ে। অমনি যক্ষ ঠিক করল মেঘকে দূত করে খবর পাঠাবে প্রিয়তমার কাছে। তখন, হাজার দেড়েক বছর আগে ডাক বিভাগ ছিল না। মেঘ ছাড়া কে খবর নিয়ে যেতে পারবে? যক্ষ তাই বসন্ত-গ্রীষ্মে ফোটা কুর্চি ফুল দুই হাতে নিয়ে মেঘকে 'মোহন, প্রীতিময় বচনে' জানাল তার দুঃখের কথা। এই নিয়ে কালিদাস লিখেছেন 'মেঘদূত' নামক বিখ্যাত কাব্য। গ্রীষ্ম-বর্ষার এত ফুল থাকতে কুর্চি ফুল কেন বেছে নিলেন কালিদাস বা তাঁর নায়ক যক্ষ নামক সাধারণ মানুষটি! বিরহী যক্ষ নবীন মেঘ দেখে বলছে...............
'কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে যদি-না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গল-বার্তা? যক্ষ অতএব কুড়চি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য স্বাগত-সম্ভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।'
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও কুড়চির সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলেন , তিনি তাঁর বনবানী গ্রন্থে লিখেছিলেন.................. " অনেককাল পূর্বে শিলাইদহ থেকে কলকাতায় আসছিলেম। কুষ্টিয়া স্টেশনঘরের পিছনের দেয়ালঘেঁষা এক কুরচিগাছ চোখে পড়ল । সমস্ত গাছটি ফুলের ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত। চারি দিকে হাটবাজার ; এক দিকে রেলের লাইন , অন্য দিকে গোরুর গাড়ির ভিড় , বাতাস ধুলোয় নিবিড়। এমন অজায়গায় পি.ডব্লু.ডি-র স্বরচিত প্রাচীরের গায়ে ঠেস দিয়ে এই একটি কুরচিগাছ তার সমস্ত শক্তিতে বসন্তের জয়ঘোষণা করছে— উপেক্ষিত বসন্তের প্রতি তার অভিবাদন সমস্ত হট্টগোলের উপরে যাতে ছাড়িয়ে ওঠে এই যেন তার প্রাণপণ চেষ্টা । কুরচির সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয়।
ভ্রমর একদা ছিল পদ্মবনপ্রিয় ,
ছিল প্রীতি কুমুদিনী পানে ।
সহসা বিদেশে আসি , হায় , আজ কি ও
কূটজেও বহু বলি মানে!
পদ্মফুলে কে না মুগ্ধ? কিন্তু কুরচিতে? ভ্রমর নাকি পদ্ম ভুলে কুরচির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। সে অপরাধের খাড়া পড়ল কুরচির উপর। অপরাধ তার আরও ছিল বৈ কি! চিরবসন্ত-স্বর্গে মহেন্দ্রের নন্দনকাননে শ্বেতশুভ্র ফুলের প্রতীক ছিল কুরচি। ইন্দ্রাণীর কবরী সজ্জায় সে অপরিহার্য, পারিজাতমঞ্জরির লীলাসঙ্গীও। “পুর্ণিমার অমল চন্দনে” চর্চিত কুরচি আন্দোলিত হত নৃত্যরতা অপ্সরীর মণিবন্ধে। তাকে কিনা এক বেদেনি চুরি করে নিয়ে এল ধূলার ধরায়, আর নাম ভাড়িয়ে লুকিয়ে রাখল ঘরের কানাচে!
শ্বেতভুজা ভারতীয় বীণা এই আভিজাত্যহীনা, নামের গৌরবহারা কুরচিকে অলংকারঝংকারিত কাব্যের মন্দিরে অভ্যর্থনা করে নি। শুভদৃষ্টি ঘটে নি, ঔদাস্যে অবহেলায় তাই কুণ্ঠিতা কুরচি। সে লজ্জায় বিমূঢ় রবীন্দ্রনাথ,
“আমি কবি লজ্জা পাই কবির অন্যায় অবিচারে
হে সুন্দরী। শাস্ত্রদৃষ্টি দিয়ে তারা দেখেছে তোমারে,
রসদৃষ্টি দিয়ে নহে;”
হায়! এ জগতে শাস্ত্রদৃষ্টি কতই না অনাচার ঘটায় ! বেদেনির স্পর্শ কি তবে কুরচিকে অস্পৃশ্য করেছিল? মূল্যহীন তাঁর কাছে রসদৃষ্টি, পোয়েটিক জাস্টিস! কিন্তু কবি সদম্ভে ঘোষণা করেন তাঁর অবস্থান। তাঁর পক্ষপাত কুরচির প্রতিই,
— সংস্কৃত শ্লোকের অনুবাদ
কুরচি , তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা
যে ভ্রমর , শুনি নাকি তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা ।
আমি সেই ভ্রমরের দলে । তুমি আভিজাত্যহীনা ,
নামের গৌরবহারা ; শ্বেতভুজা ভারতীয় বীণা
তোমারে করে নি অভ্যর্থনা অলংকারঝংকারিত
কাব্যের মন্দিরে । তবু সেথা তব স্থান অবারিত ,
বিশ্বলক্ষ্মী করেছেন আ মন্ত্রণ যে প্রাঙ্গণতলে
প্রসাদচিহ্নিত তাঁর নিত্যকার অতিথির দলে ।
আমি কবি লজ্জা পাই কবির অন্যায় অবিচারে
হে সুন্দরী । শাস্ত্রদৃষ্টি দিয়ে তারা দেখেছে তোমারে ,
রসদৃষ্টি দিয়ে নহে ; শুভদৃষ্টি কোনো সুলগনে
ঘটিতে পারে নি তাই , ঔদাস্যের মোহ-আবরণে
রহিলে কুণ্ঠিত হয়ে ।
তোমারে দেখেছি সেই কবে
নগরে হাটের ধারে জনতার নিত্যকলরবে ,
ইঁটকাঠপাথরের শাসনের সংকীর্ণ আড়ালে ,
প্রাচীরের বহিঃপ্রান্তে। সূর্যপানে চাহিয়া দাঁড়ালে
সকরুণ অভিমানে; সহসা পড়েছে যেন মনে
একদিন ছিলে যবে মহেন্দ্রের নন্দনকাননে
পারিজাতমঞ্জরির লীলার সঙ্গিনীরূপ ধরি
চিরবসন্তের স্বর্গে, ইন্দ্রাণীর সাজাতে কবরী;
অপ্সরীর নৃত্যলোল মণিবন্ধে কঙ্কণবন্ধনে
পেতে দোল তালে তালে; পুর্ণিমার অমল চন্দনে
মাখা হয়ে নিঃশ্বসিতে চন্দ্রমার বক্ষোহার-'পরে।
অদুরে কঙ্কররুক্ষ লৌহপথে কঠোর ঘর্ঘরে
চলেছে আগ্নেয়রথ, পণ্যভারে কম্পিত ধরায়
ঔদ্ধত্য বিস্তারি বেগে; কটাক্ষে কেহ না ফিরে চায়
অর্থমূল্যহীন তোমা-পানে, হে তুমি দেবের প্রিয়া,
স্বর্গের দুলালী। যবে নাটমন্দিরের পথ দিয়া
বেসুর অসুর চলে, সেইক্ষণে তুমি একাকিনী
দক্ষিণবায়ুর ছন্দে বাজায়েছ সুগন্ধ-কিঙ্কিণী
বসন্তবন্দনানৃত্যে-- অবজ্ঞিয়া অন্ধ অবজ্ঞারে,
ঐশ্বর্যের ছদ্মবেশী ধূলির দুঃসহ অহংকারে
হানিয়া মধুর হাস্য; শাখায় শাখায় উচ্ছ্বসিত
ক্লান্তিহীন সৌন্দর্যের আত্মহারা অজস্র অমৃত
করেছে নিঃশব্দ নিবেদন।.........
মোর মুগ্ধ চিত্তময়
সেইদিন অকস্মাৎ আমার প্রথম পরিচয়
তোমা-সাথে। অনাদৃত বসন্তের আবাহন গীতে
প্রণমিয়া উপেক্ষিতা, শুভক্ষণে কৃতজ্ঞ এ চিতে
পদার্পিলে অক্ষয় গৌরবে। সেইক্ষণে জানিলাম,
হে আত্মবিস্মৃত তুমি, ধরাতলে সত্য তব নাম
সকলেই ভুলে গেছে , সে নাম প্রকাশ নাহি পায়
চিকিৎসাশাস্ত্রের গ্রন্থে, পণ্ডিতের পুঁথির পাতায়;
গ্রামের গাথার ছন্দে সে নাম হয় নি আজও লেখা,
গানে পায় নাই সুর। সে নাম কেবল জানে একা
আকাশের সূর্যদেব, তিনি তাঁর আলোকবীণায়
সে নামে ঝংকার দেন, সেই সুর ধুলিরে চিনায়
অপূর্ব ঐশ্বর্য তার; সে সুরে গোপন বার্তা জানি
সন্ধানী বসন্ত হাসে। স্বর্গ হতে চুরি করে আনি
এ ধরা, বেদের মেয়ে, তোরে রাখে কুটির-কানাচে
কটুনামে লুকাইয়া, হঠাৎ পড়িস ধরা পাছে।
পণ্যের কর্কশধ্বনি এ নামে কদর্য আবরণ
রচিয়াছে; তাই তোরে দেবী ভারতীর পদ্মবন
মানে নি স্বজাতি বলে, ছন্দ তোরে করে পরিহার--
তা বলে হবে কি ক্ষুণ্ন কিছুমাত্র তোর শুচিতার।
সূর্যের আলোর ভাষা আমি কবি কিছু কিছু চিনি,
কুরচি, পড়েছ ধরা, তুমিই রবির আদরিণী।"
“নগরে হাটের ধারে, জনতার নিত্যকলরবে,
ইঁটকাঠপাথরের শাসনের সংকীর্ণ আড়ালে,
প্রাচীরের বহিঃপ্রান্তে।”
যার অঢেল উপস্থিতি, তাকে নিশ্চয়সকলেই ভোলে নি।”জনতার নিত্যকলরবে” কুরচি ঠিকই আছে আপন মহিমায়। তাই থাক না কিছু ভুলভাল কাব্যকৃতিতে! কতটুকু ক্ষতিতাতে? মূলবাণী পেয়ে গেছি রবীন্দ্রনাথেই। দেবী ভারতীর পদ্মবন স্বজাতি বলে না মানুক, ছন্দ তাকে যতই পরিহার করুক তাতে কুরচির শুচিতা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয় নি। দেবের প্রিয়া, স্বর্গের দুলালী কুরচিকে ঠিকই চিনেছেন সূর্যদেব। কবি তাই নিশ্চিন্ত হন,
“সূর্যের আলোর ভাষা আমি কবি কিছু কিছু চিনি,
কুরচি, পড়েছ ধরা, তুমিই রবির আদরিণী।”
এখানে আবার দেখি সূর্যদেব আর কবি রবি একাকার! কার আদরিণী কুরচি? শুধুই সূর্যদেব রবির, না-কি কবিরও যার নাম রবি?
ভারতবর্ষের আদি নিবাসী কুরচি মাঝারি আকৃতির বৃক্ষ। কাণ্ড সরল, বাকল অমসৃণ ও হালকা ধূসর রঙের। অজস্র ঊর্ধ্বমুখী শাখায় এলোমেলো। পাতা লম্ব-ডিম্বাকৃতির, মসৃণ এবং উভয়ের বিপরীত দিকে সমভাবে বিন্যস্ত থাকে। শীতে পত্রহীন হয়, ফাল্গুনের শেষভাগে দুয়েক স্তবক ফুল ফুটতে শুরু করে।
ফুল, বাকল ও ফল আমাশয়ের ওষুধ। তাছাড়া ফুল রক্তদোষে, পাতা বাত ও ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসে, বীজ অর্শ্ব ও একজিমায় উপকারী। সর্পদংশন এবং বিছার কামড়েও এ গাছের বাকল ব্যবহার করা হতো। নরম কাঠ থেকে পুতুল ও খেলনা তৈরি হয়।
কুরচির অন্যান্য নাম- কুটজ, ইন্দ্রযব, ইন্দ্রজৌ, বৎসক, কলিঙ্গ, প্রাবৃষ্য, শত্রুপাদপ, সংগ্রাহী, পান্ডুরদ্রুম, মহাগন্ধ, ইংরেজিতে Bitter Oleander, Easter Tree।
আকৃতিতে কামিনীর সাথে বেশ মিল, বর্ণেও। তবু কামিনীর সলাজ ঝরে পড়ার সাথে কুরচির বেমিল নজর কাড়ে। বসন্তে সে প্রস্ফূটনে মাতে, থাকে সমস্ত গ্রীষ্মব্যাপী, বর্ষণসিক্ত হয়ে তার প্রস্ফুটনে যতি। প্রথম পর্বে, বসন্তে শুধুই তুষারধবল কুরচিতে মোড়া নিষ্পত্র তরুটি। দিন যত দীর্ঘতর হয়, উত্তাপ যত বাড়ে, গ্রীষ্মের আগমনে সবুজ পাতা আর সাদা ফুলে লুকোচুরির মনোহরণ দৃশ্য যে দেখে সেই মজে। এদেশে এমন শ্বেত, তুষারধবল ফুলের অক্লান্ত দীর্ঘস্থায়ী প্রস্ফূটনের বন্যা বেশি নেই। কুরচি তাই আমাদের প্রিয় ফুলের তালিকাশীর্ষে স্থান পেতেই পারে।
আমাদের ওঙ্কার ধামের প্রথম কুড়চি গাছটি আমার মায়ের লাগানো , গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় কামিনী ও কুড়চির সুগন্ধি যুগলবন্দী প্রান ভরিয়ে দেয় .........
বসন্তে নিষ্পত্র তরুজুড়ে বরফশুভ্র এমন অনিন্দ্য সুন্দর পুষ্প এ বাংলায় দ্বিতীয়টি নেই।এমন তুষারধবল, প্রস্ফূটনে ক্লান্তিহীন কুরচিকে আমরা আমাদের নাগরিক জীবনে আনন্দের উৎসে পরিণত করতে পারি। আমাদের উদ্যান চর্চায় কেন তবে কুরচি অবহেলিত থাকবে? আসুন, সবাই মিলে এই অপরূপ শ্বেতশুভ্র পুষ্পে ভরে তুলি আমাদের স্বপ্নের বাড়ি,স্বপ্নের নগর,...............
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন