শনিবার, ২৭ মে, ২০১৭

বাংলার পুস্পিত বৃক্ষ

পৃথিবীর অন্যতম উর্বর ভূখণ্ড এই বাংলায় স্বাভাবিক উদ্ভিদের সংখ্যা অজস্র। সেই উদ্ভিদরাজ্যে ফুলেল বৃক্ষের সংখ্যাও অগুনতি। তাতে তৃণ থেকে মহিরুহের কমতি নেই, কিন্তু অপরিণামদর্শীদের কবলে পড়ে রবীন্দ্রনাথ,নজরুল ও জীবনানন্দের সোনার বাংলা অনেকটাই শ্রীহীন।

লাল সোনাইল

  আমি মনে করি, বন বিভাগ ও উদ্যান উন্নয়ন বিভাগ এগিয়ে এলে এ সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। স্বল্প মূল্যে ও সহজলভ্য বৃক্ষের কি সত্যিই আকাল পড়েছে দেশে? গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সঠিক বৃক্ষ নির্বাচন। বসন্তে পল্লিবাংলা লাল শিমুলে ভরে উঠলেও নগরে তার যেন কোনো প্রবেশাধিকার নেই। নগরে পারিজাত তো ব্রাত্যই, গ্রামেও এখন এর কদর কম।

 শহর আলো করে তুলতে পারত অশোক। এই অসাধারণ সুন্দর উজ্জ্বল ফুল ও পল্লবশোভিত, ভেষজ তরুটিকেও আমরা নগরে লালন করতে চাই না। এককালে কুসুম ফুলে ভরে থাকত নদীবিধৌত বাংলা। এখন এর নামটিও হারিয়ে যাচ্ছে। পলাশ একে ক্ষণস্থায়ী, তাতে নগর সৌন্দর্যায়ণে তার তেমন কদর নেই, যতটা আছে কবিতায়, সাহিত্যে। প্রস্ফুটনের প্লাবন ও ঔজ্জ্বল্যে পলাশের সঙ্গে তুলনীয় এক বাসন্তিকা অপ্রিয় গন্ধি জংলি বাদাম। দ্বিজেন শর্মার ভাষায়, ‘শুধু প্রস্ফুটনের অপ্রিয় গন্ধের প্রসঙ্গ বাদ দিলে ঋজুতা, বলিষ্ঠতা ও সৌন্দর্যে ছায়ানিবিড় এই বৃক্ষটি আমাদের তরুরাজ্যের যোগ্য প্রতিনিধি।’
কাঞ্চনও কেন দুর্লভ এই মহানগরে? নানা রঙের কাঠগোলাপও কেন চোখ কাড়ে না? শীত-বসন্তে আলো ছড়ায় আফ্রিকান টিউলিপ, কোনো বিলাসীর বাড়ির আঙিনায় হয়তো তার ঠাঁই আছে, কিন্তু নগরজীবনে এর  উপস্থিতি অনেক কম। গত বসন্তে কলকাতা শহরের কিছু অংশে আলো করে থাকতে দেখলাম আফ্রিকান টিউলিপ, রুদ্রপলাশ, জারুল ও কনকচূড়া কে ... মন ভরে গেল ।

জাকারান্ডা, নাগলিঙ্গম রাজধানীর প্রিয় তরু হবে না কেন? এর পাশে থাকুক বোতল ব্রাশও। আমাদের নগর সৌন্দর্যায়ণে বরফশুভ্র কুরচি কেন স্থান পাবে না?

 কুরচির সৌন্দর্যে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ঐশ্বর্যের ছদ্মবেশী ধূলির দুঃসহ অহংকারে/ হানিয়া মধুর হাস্য; শাখায় শাখায় উচ্ছ্বসিত/ ক্লান্তিহীন সৌন্দর্যের আত্মহারা অজর অমৃত/ করেছ নিঃশব্দে নিবেদন।’ কিন্তু না,  শহরে কুরচির সাদর রোপণ চোখে পড়ে না। নিতান্ত অবহেলায় সে জন্মে দেশের নানা প্রান্তে, থাকেও যেন অপরিচিত, বিশেষত ভদ্রসমাজে।
 বাংলা তো শাল-পিয়ালের দেশ।  লালমাটির আত্মজ ঋজু শালবৃক্ষ কেন নির্বাসিত থাকবে আমাদের শহর থেকে......? ফাল্গুনে নিষ্পত্র হয়ে কোমল, রোমশ সাদা দীর্ঘ মঞ্জরিতে আচ্ছন্ন হয়ে ‘সৌরভধনে তখন তুমি হে শালমঞ্জরী বসন্তে কর ধন্য।’
অঞ্জন

গ্রীষ্মে বাংলাদেশ পত্রপল্লবে সুশোভিত হয়। তপ্ত ধরণি নববর্ষায় সিক্ত হয়ে উদ্ভিদরাজ্যে নবজীবনের সঞ্চার করে। গ্রীষ্মের সবচেয়ে উজ্জ্বল পুষ্প নিঃসন্দেহে কৃষ্ণচূড়া। তার পাশেই আমাদের একান্ত দেশীয় পুষ্প জারুল আর সোনালু আমাদের ক্লান্ত জীবনকে বর্ণিল করে তোলে। এই ত্রিরত্ন কেন সারা বাংলার সমস্ত রাজপথ জুড়ে ওদের সৌন্দর্যের দ্যুতি ও স্নিগ্ধ ছায়া ছড়াবে না? কেরালা, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, হায়দরাবাদ যদি এই তিনের সমারোহে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে, আমার সোনার বাংলা  পারে না কেন?
একসময় বর্ধমান জেলার কালনা শহর থেকে হুগলী জেলার প্রাচীন শহর পান্ডুয়া পর্যন্ত রাস্তার (কালনা পান্ডুয়া রোড) দুই ধার  অরুণাভ পত্রঘন নাগেশ্বরে আর বিভিন্ন আমগাছে ভরে ছিল, চিরহরিৎ, নিশ্ছিদ্র ও ছায়ানিবিড় অপরূপ সৌন্দর্যময় এই দেশীয় তরু কী কারণে বৃক্ষ হন্তারকদের লোভ ও ক্রোধের শিকার হলো? উষ্ণায়ণ রোধে, সৌন্দর্যায়ণে কেন নাগেশ্বর আমাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে স্থান পাবে না?
 একটা ব্যক্তিগত কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার কথা বলি৷ আমার বাচ্চাকে শিখিয়েছি, গাছ কাটতে নেই, লাগাতে হয়৷
     বছর তিনেক আগে হঠাৎ দেখলাম আমাদের আসাম রোড (এস টি কে কে রোড )  চওড়া করার জন্য শতাব্দী প্রাচীন ( হয়ত বা কয়েক শতাব্দী প্রাচীন ) বিরাট বিরাট শিরীষ গাছগুলিকে নির্মমভাবে কেটে ফেলা হলো কোনো নতুন গাছ না লাগিয়েই৷ আমার মেয়ে তিতলি আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘‘বাবা , গাছ কাটা তো খারাপ কাজ, তাহলে এতগুলো গাছ কেটে ফেলল কেন?'' বিশ্বাস করুন, আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি৷ কীভাবে তাকে আমি বলব যে, বড় হলে আমাদের মধ্যে একটা জিনিস জন্ম নেয় যার নাম ‘হিপোক্রেসি'৷ যতক্ষণ না আমরা এই হিপোক্রেসির হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছি, ততক্ষণ আমাদের কথা আর কাজের মধ্যে রয়ে যাবে বিস্তর ফারাক৷ আমরা অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে চলি, ‘কর্তব্য বিষয়ে ভালো ভালো কথার জন্ম হয়েছে আমার বলার জন্য, আর অন্যদের করার জন্য', অন্তত আমার দেশে৷ তাই আমরা স্লোগান দিই, ‘গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান'৷ কখনোই বলি না, ‘এসো গাছ লাগাই, প্রাণ বাঁচাই'৷ আমাদের বাসের পিছনে লেখা থাকে না, ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলি', লেখা থাকে ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন'৷  অর্থাৎ আমার কোনো দায় নেই! আজ আমাদের এস টি কে কে রোড ঝাঁ চকচকে,গাড়ী চলে সাবলীল ভাবে ,বান্ডেল থেকে কাটোয়া পর্যন্ত রাস্তা শুয়ে আছে একটা বড়ো অজগরের মতো,গাড়ি চলছে সাঁ সাঁ করে ,.........ঠা ঠা রোদ্দুরে অজগরের পিঠ চক চক করছে ,আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের সেই ছায়া - সুনিবিড় পথ। খামারগাছী পেরোলেই চোখে পড়ে রাস্তার ধারে পরে আছে শিরীষ ,বাবলা,জারুল,কৃষ্ণচূড়াদের টুকরো টুকরো লাশ।
 গাছগাছালি মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শুধু মানুষই নয়, গাছপালা ছাড়া কোনো প্রাণীই জীবন ধারণ করতে পারবে না। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বেড়ে পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধানত দায়ী বৃক্ষহীনতা। দিন দিন কমে যাচ্ছে গাছের সংখ্যা। গাছপালার স্বল্পতার কারণে ভূপৃষ্ঠে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ভয়াবহভাবে বেড়ে যাচ্ছে। গাছগাছালির উপকারের কোনো শেষ নেই। একটি গাছ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে।
 উষ্ণায়ণ রোধে  আমাদের বৃক্ষরোপণ পরিকল্পনায় কাঠবাদাম ও কদমকে অবশ্যই স্থান দিতে হবে। সেই সঙ্গে নিম ও বকুলকেও। কেন আবর্জনায় ক্লিষ্ট, দুর্গন্ধময় এই শহরে প্রচুর ছাতিম থাকবে না? তেলশুর, পাদাউক প্রাধান্য পায় না কেন? মহাশিরীষ, গগনশিরীষ, হিজল, তমাল, দেবদারু, অশ্বত্থ, উদয়পদ্ম, গাব, গামারি, হরেক রকম চাঁপা, বরুণ, বুদ্ধনারকেল, মহুয়া, মুচকুন্দ, চন্দন ইত্যাদি বৃক্ষের ব্যাপক ও পরিকল্পিত রোপণ কাঙ্ক্ষিত।
বছর কয়েক আগের কথা , আমার মেয়ে তিতলি তখন দশম শ্রেণী , আমাদের ব্লক এ নগরায়ন ও সবুজ নিয়ে একটি আন্তঃ স্কুল বিতর্কের আয়োজন করা হয়েছিল , তিতলির তাতে অংশগ্রহণ করেছিল । অনুষ্ঠান টি হয়েছিল আমাদের বাড়ি থেকে একটু দুরে(১৪ কিমি) কামারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেদিন আমার ছুটির দিন থাকায় আমরা (স্ত্রী স্বাতী ও তিতলি) হাজির হলাম ওই বিদ্যালয়ে । সারা স্কুল জুড়ে সবুজের সমারোহ , কেয়ারি করা বাগান ! প্রধান শিক্ষকের সাথে আলাপ হতেই তিনি নিজে আমাদের সারা বিদ্যালয় ও বাগান ঘুরিয়ে দেখালেন । আমলকী ,হরিতকি, তমাল, রুদ্রপলাশ, মহাশিরীষ, গগনশিরীষ, হিজল, , দেবদারু, অশ্বত্থ, উদয়পদ্ম, গাব, গামারি, হরেক রকম চাঁপা, বরুণ, বুদ্ধনারকেল, মহুয়া, মুচকুন্দ, চন্দন, শ্বেত শিমুল, কি নেই সেখানে !!! মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেল । ওনার মত বিনয়ী মানুষ বেশ কম , উনি  এ বাগানের সৌন্দর্যের কৃতিত্ব সবটুকুই ওনার ছাত্র ছাত্রীদের দিলেন ।
 যখন সারা বাংলা জুড়ে বৃক্ষ নিধন ও নগরায়ন চলছে , তখন তিনি নিঃশব্দে ছোটছোট ছেলে মেয়েদের (পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণী) নিয়ে গড়ে তুলেছেন, সবুজের সমারোহ , পাখিদের আবাসস্থল ।
সর্বত্রই কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ থাকেন, কথা নয়, কাজই যাঁদের জীবনাদর্শ৷ তাঁদের কাজের ফলেই সভ্যতা কালো থেকে আলোর দিকে, মন্দ থেকে ভালোর দিকে এগিয়ে চলে৷ তাঁদের কথা মনে রেখেই আমরা নিজেদের সন্তান-সন্ততির জন্য আগামীদিনে একটু অন্যরকম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে সাহস পাই৷





   আমার সোনার বাংলা সেজে উঠুক অর্জুন, আমলকী, বহেড়া, খুদে জাম, টক আম, কালোজাম, ক্ষীর খেজুর, গোলাপজাম, চালতা, জলপাই, বাতাবি লেবু, আমড়া, তেঁতুলের মতো ভেষজ ও ফলদ বৃক্ষে। রাস্তার দুই পাশে গাছে গাছে শোভা পাক নানা রঙের অর্কিড, নাগানবিলাস, মধুমঞ্জরিসহ গোল্ডেন শাওয়ার, ঝুমকো লতা, হানিমুন ক্রিপার, আইভি লতা, টেকুমা ইত্যাদি।

ফুলের কথা উঠলে আগে আসে ঋতুরাজ বসন্তের কথা। কিন্তু গ্রীষ্মেও  ফোটে নানা রঙের বাহারি ফুল। প্রচণ্ড দাবদাহে কিছুটা হলেও প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় এসব ফুল। হলুদ সোনালু, বেগুনি জারুল ও লাল কৃষ্ণচূড়া এদের মধ্যে অন্যতম।
এছাড়া গ্রীষ্মে ফোটে আরো নানা ফুল। এদের মধ্যে কাঁটার মুকুট বা ক্রাউন অব থর্ন, গন্ধরাজ, লাল চাঁপা, সাদা চাঁপা, চুলের বেণির মতো গোলাপি অর্কিড ও মে ফ্লাওয়ার সহ কত কী!
গ্রীষ্মের চোখ জুড়ানো বর্ণিল ফুল বাঙ্গালী মনকে নাড়া দেয় খুব গভীরভাবে। ইট পাথরের শহর ছেড়ে একটু গ্রামীণ প্রকৃতির কাছে গেলেই এসময় চোখে পড়বে এসব বাহারি ফুল।
অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে আমাদের চিরচেনা এসব ফুলেল বৃক্ষরাজি বহু আগেই শহর থেকে নির্বাসিত হয়েছে। তাই গ্রীষ্মের এসব ফুল সম্পর্কে  বর্তমান প্রজন্মের তেমন  ধারণা নেই বললেই চলে।

কৃষ্ণচূড়া

কৃষ্ণচূড়া গ্রীষ্মের অতি পরিচিত একটি ফুল। বাংলা কাব্য, সাহিত্য, সংগীত ও বিভিন্ন উপমায় কৃষ্ণচূড়া ফুলের কথা ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে। শোভাবর্ধণকারী এ বৃক্ষটি গ্রামের পাশাপাশি এখনো তার নড়বড়ে অস্থিত্ব নিয়ে কোনো রকমে টিকে আছে শহরের পথে প্রান্তরে। আমাদের দেশে দুই ধরনের কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটতে দেখা যায়। একটি আগুনের মতো উজ্জ্বল লাল অন্যটি লাল হলদেটে। তবে লাল কৃষ্ণচূড়ার প্রাচুর্যতাই বেশি চোখে পড়ে। লাল হলদেটে রংয়ের কৃষ্ণচূড়া বর্তমানে বেশ বিরল।
লাল হলদেটে ফুলের কৃষ্ণচূড়াকে অনেকে রাধাচূড়া বলে থাকে। রাধাচূড়া ফুলে মূলত লাল ও হলুদের সংমিশ্রণ দেখা যায়। তবে কনকচূড়া ফুল সম্পূর্ণ রূপে হলুদ হয়ে থাকে।  ইদানিং  রাস্তার পাশে কনকচূড়া ফুল বেশ  চোখে পড়ে।
কৃষ্ণচূড়ার আদি নিবাস পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার, রাধাচূড়ার জন্ম ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর কনকচূড়ার জন্মস্থান শ্রীলংকা বা অস্ট্রেলিয়া। ভীনদেশি এ ফুলেল বৃক্ষগুলো আমাদের দেশে এসে নতুন নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। ধারণা করা হয় হিন্দু পুরাণের রাধা ও কৃষ্ণের নামানুসারে বৃক্ষ দুটির নাম হয়েছে কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া।

তবে কনকচূড়ার নাম হাল আমলে বৃক্ষপ্রেমীরা দিয়েছেন বলে অনুমেয়। গ্রীষ্মে যখন কৃষ্ণচূড়া ফোটে এর রূপে মুগ্ধ হয়ে ব্যস্ত পথচারীও থমকে তাকায় কিছু সময়ের জন্য।

জারুল

গ্রীষ্মের দাবদাহে চোখ ধাঁধাঁনো বেগুনি রংয়ের বিচ্ছুরণ নিয়ে প্রকৃতিতে নিজের আগমনের কথা জানান দেয় জারুল ফুল। গ্রীষ্মের ফুল হিসেবে জারুল অতুলনীয়। বর্তমানে শহরে জারুল গাছ খুবই বিরল। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনো জারুল গাছের আধিক্য লক্ষ করা যায়। চমৎকার বেগুনি রংয়ে রাঙ্গানো এ জারুল ফুল আমাদের মনের গহীনে জাগ্রত করে এক অন্য রকম ভাললাগা।
সোনালু

হলুদে ছাওয়া ঝুমকার মতো ঝুলে থাকা সোনালু ফুল যে কারো মন ছুঁয়ে যাবে। সোনালু গাছ আমাদের দেশে ঔষধি গাছ হিসেবেই বেশি পরিচিত। গ্রামাঞ্চলে এ গাছকে অনেকে বানর লাঠি গাছও বলে থাকে। সোনালু গাছের ফল ঠান্ডা ও কাশি উপশমের জন্য বেশ উপকারী।
আমাদের দেশে সোনালু গাছ আগের মতো তেমন একটা চোখে পড়েনা। তবে গ্রামে এখনো কিছু সোনালু গাছ দেখতে পাওয়া যায়। ঝুমকা ঝুমকা সোনালু ফুলের রূপ সৌন্দর্য সবাইকে নিয়ে যায় ভাবনার জগতে। গ্রীষ্মের বাতাসে হলুদ সোনালু ফুলের দোলা প্রকৃতিতে সৃষ্টি করে এক অন্য রকম আবহ। গ্রীষ্মের ফুল হিসেবে সোনালু ফুল এক কথায় অনন্য। প্রতি বছর গ্রীষ্মে হলুদ পরী হয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয় সোনালু ফুল।
হিজল
 
"এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে— সবচেয়ে সুন্দর করুণ:
সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বথ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ"
— জীবনানন্দ দাশ
— 

ঐতিহ্যবাহী গাছের মধ্যে হিজল গাছ একটি। এ গাছটি আমাদের প্রকৃতি থেকে দিন দিন হারিয়েই যাচ্ছে। হিজল গাছ পুকুর, খাল ও জলাশয়ের ধারে বেশি জন্মায়। হিজল গাছের সবচেয়ে বেশি ভাললাগার দিকটি হচ্ছে এর চমৎকার ফুল।
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে হিজল গাছে ফুল ফুটতে শুরু করে। রক্ত রাঙ্গা হিজল ফুলের লহরি আর মাতাল ঘ্রাণ সবাইকে বিমোহিত করে তোলে। ছোট আকৃতির রক্ত রাঙ্গা হিজল ফুল গাছের নিচে ঝরে পড়ে সৃষ্টি করে এক দৃষ্টি নন্দন পুষ্প শয্যা।
চিরায়ত বাংলার হিজল ফুলের প্রেমে পড়ে অনেক কবি -সাহিত্যিক রচনা করেছেন বহু গল্প-কবিতা। তাই বাঙ্গালী হৃদয়ে হিজল ফুলের আবেদন হয়তো কখনো ফুরাবে না।

গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে চারদিক যখন খাঁখাঁ করছে, প্রচণ্ড গরমে জীবন যখন ওষ্ঠাগত, শরীর থেকে ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে— এমন পরিস্থিতিতে তখন আপনি কোনো বাহনে কিংবা পায়ে হাঁটার সময় রাস্তার পাশে প্রকৃতিতে দেখতে পাবেন ব্যতিক্রমী এক দৃশ্য। শহর কিংবা গ্রামের গাছে গাছে যেন মেলা বসেছে বাহারি ফুলের।
  

.রক্তরাগ\স্কারলেট কর্ডিয়া 

 "..লাল রঙে রঞ্জিত ওগো রক্তরাগ ,
তোমায় দিয়ে সাজাব আমার কুসুমবাগ "।


ফুলের নাম- রক্তরাগ, স্কারলেট কর্ডিয়া
বৈজ্ঞানিক নাম- Cordia sebestena
পরিবার- Boraginaceae
অন্যান্য নাম- siricote/kopté (Mayan), Geiger Tree, scarlet cordia



স্কারলেট কর্ডিয়া-এর আদি আবাস কিউবা ও পেরু হলেও এই কিউবিয়ান সুন্দরী  আমাদের আপন হয়ে গেছে । এর বাংলা নাম হল ....রক্তরাগ !! অসাধারণ রঙ আর রূপের সঙ্গে এর রক্তরাগ নামটি বেশ মানানসই । গাছের শাখায় গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের শোভা এক পলকেই সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ফুলের উজ্জ্বল কমলা রঙ আর পাতার টিয়ে সবুজ রঙে কর্ডিয়ার অপূর্ব সাজ বেশ নজরকাড়া। গাছে ফুল থাকে প্রায় সারা বছরই, তবে শীত থেকে বসন্তে বেশি।




        মম    হৃদয়রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া,
                   অয়ি    সন্ধ্যাস্বপনবিহারী।
          তব    অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া--
                   তুমি    আমারি, তুমি আমারি,
                   মম    বিজনজীবনবিহারী॥
মম      মোহের স্বপন-অঞ্জন তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে,
                   অয়ি    মুগ্ধনয়নবিহারী
মম      সঙ্গীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে--
                   তুমি    আমারি, তুমি আমারি,
                   মম    জীবনমরণবিহারী॥

তুমি    সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
                   মম    শূন্যগগনবিহারী।
আমি    আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা--
                   তুমি    আমারি, তুমি আমারি,
                   মম     অসীমগগনবিহারী॥

 সুন্দরীর কথা :- আঠার শতকে ওলন্দাজরা এ গাছ ভারতে নিয়ে আসে।
১)গাছ ছোটখাটো, ৫ থেকে ৮ মিটার উঁচু, চিরসবুজ, কখনো গুল্ম আকারের।
২)পাতা একক, ১০ থেকে ১৮ সেমি লম্বা, ডিম্বাকার বা উপবৃত্তাকার।
৪) ডালের আগায় গুচ্ছবদ্ধ ফুল ফোটে প্রায় সারা বছর।
৫) ফুল ৩ থেকে ৫ সেমি লম্বা, পাপড়ি সংখ্যা ৬।
৬) ফল ডিম্বাকার, শাঁসাল, প্রায় ৪ সেমি লম্বা, বৃতিযুক্ত। বীজ আঠাল শাঁসে জড়ানো।
৭) শুষ্ক অঞ্চলে ভালো বাড়ে। বীজ, কলম ও দাবাকলমে চাষ।


কদম ফুল 

 

"বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
 আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।।
 মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে
 এই যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান।।
 আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল
 রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।
 এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে
 তব বিস্মৃতিস্রোতের প্লাবনে
 ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী
 বহি তব সম্মান।।"


জ্যাকারান্ডা 

 

জ্যাকারান্ডা দেশি গাছ নয়, জন্মস্থান ব্রাজিল। এ সুদর্শন গাছটি আমাদের বাংলায়  প্রায় ৭০-৮০ বছর আগে এলেও ততটা বিস্তার লাভ করেনি। প্রধান কারণ হিসেবে জলাবদ্ধতাকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা আমাদের জলীয় ভিজে আবহাওয়াকে এ গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা মনে করেন। জ্যাকারান্ডা মাঝারি আকৃতির পত্রমোচি বৃক্ষ। কাণ্ড মসৃণ ও হালকা ধূসর রঙের। পাতা চিরল চিরল, কারুকার্যময় ও বিন্যাস বিপ্রতীপ। গ্রীষ্মের প্রথম ভাগেই নতুন পাতা গজাতে শুরু করে।
 তার পর পরই প্রায়-পাতাহীন ডালের আগায় গুচ্ছবদ্ধ ফুল ফুটতে শুরু করে। পরিপূর্ণ প্রস্টম্ফুটিত জ্যাকারান্ডার জৌলুস সত্যিই মনোমুগ্ধকর। তা ছাড়া এ ফুল চটজলদি ঝরেও পড়ে না। অনেক দিন ধরেই এর শোভা উপভোগ করা যায়। ফুলের রঙ বেগুনি, দেখতে নলাকার, ২ ইঞ্চি লম্বা। এ গাছের কাঠ দামি ও সুগন্ধি। ভেতরের আঁশ বেগুনি ও কালো রেখায় চিত্রিত। জন্মস্থানে এই গাছের পাতা বক্ষরোগ ও ক্ষতের চিকিৎসায় কাজে লাগে। বাকলের নির্যাস থেকে তৈরি হয় বিভিন্ন রোগের মহৌষধ। দেশের যেসব স্থানে বন্যার পানি জমে না, সেসব স্থানে এবং পাহাড়ি এলাকায় এই গাছ বেশি পরিমাণে রোপণ করা প্রয়োজন।  আমাদের জাতীয় সড়ক পথের ধারে এক সারি জ্যাকারান্ডা রোপণ করে তার প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করা যেতে পারে। 

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু শহরে পরিকল্পিতভাবে জ্যাকারান্ডা লাগানো হয়েছে। সেখানে জ্যাকারান্ডার নীলচে-বেগুনি রঙের পাশে সিলভার ওকের হলুদ-সোনালি বর্ণ বৈচিত্র্য তৈরি করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রশাসনিক রাজধানী প্রিটোরিয়া জ্যাকারান্ডার শহর নামে পরিচিত। অবশ্য বাণিজ্যিক রাজধানী কেপটাউনেও অসংখ্য গাছ রয়েছে। জ্যাকারান্ডা অপেক্ষাকৃত কম শীতের দেশগুলোতে ভালো জন্মে। এ গাছ যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি ও জাম্বিয়ায় বেশ সহজলভ্য। আলঙ্করিক বৃক্ষ হিসেবে বর্তমানে সারা বিশ্বেই এটি বেশ জনপ্রিয়।

ফুল্লরা( ক্রেব বা ফুরুস ফুল)

কয়েক দশক ধরে চীন থেকে বহু জিনিষ এসেছে আমাদের দেশে ,প্রায় সব কিছুই অত্যন্ত নিম্নমানের। এখন অবস্থাটা এমন হয়েছে,চীনের জিনিস তাড়াতে পারলে বাঁচি,.......... কিন্তু আর মাঝেই কয়েক দশক আগে চীন থেকে আসা একটা জিনিস আমার পরম প্রিয় ,আমার ধারণা আমার মতো অনেকেরই প্রিয় জিনিসটি হলো  ক্রেব বা ফুরুস ফুল।
আগেই বলেছি এই ফুল আমাদের দেশি নয়। পোশাকি নাম ক্রেব বা ফুরুস। কিন্তু আমাদের দেশে ভুল করে এদের চেরি ফুল নামে ডাকা হয়। আদতে আমাদের দেশে চেরি ফুলের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ চেরি ফুল ফোটানোর চেষ্টা করেছেন। খুব একটা সফল হননি। বর্ণিত ফুলটি  চীনের প্রজাতি। আমাদের দেশে এসেছে মাত্র কয়েক দশক আগে। বর্ণবৈচিত্র্য, দীর্ঘ প্রস্ফুটন প্রক্রিয়া ও প্রাচুর্যের কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।  বর্ষার প্রকৃতিকে মাতিয়ে রাখতে এর কোনো জুড়ি নেই। এ গাছ প্রায় চার মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গাছটি বেশ শক্ত এবং  ডালপালায় ভরা। পাতার বিন্যাস ঘূর্ণিত এবং দেখতে ডিম্বাকৃতির। সাধারণত সাড়ে তিন থেকে ছয় সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। বর্ষাকালে ডালের আগায় ছোট ছোট ফুলের অনেক বড় বড় থোকা হয়। একেকটি ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা ও শাখায়িত। এই ফুলের অনেক রঙ_ সাদা, গোলাপি, লাল, বেগুনি।
ফুল তিন সেন্টিমিটার চওড়া এবং কোঁকড়ানো পাপড়ির সংখ্যা ছয়টি। এই ফুল গন্ধহীন হলেও সব রঙ নিয়ে চমৎকার বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা যায়। বিদেশি হলেও আমাদের দেশে এরা বেশ মানানসই,এখন আর একে বিদেশি বলে মানি হয়না। আমার মেয়ে তিতলি আর নাম দিয়েছে ফুল্লরা।
 

রূপসী রুদ্রপলাশ 

 বসন্তের শুরুতে বৃক্ষচূড়ায় রাশি রাশি রুদ্রপলাশের ফুল দেখে মানুষ অভিভূত হয়ে পড়ে। এর আদিবাস পশ্চিম আফ্রিকা হলেও আমাদের দেশে এর পরিচিতি আছে। দূর থেকে দেখতে থোকা থোকা টিউলিপ সদৃশ বলে এর ইংরাজি নাম আফ্রিকান টিউলিপ। এই ফুলের কুঁড়িতে পলাশ (Butea monosperma)এর আদল আছে, রংটাও তার মতো এবং স্বভাবে যেন রুদ্র বা উগ্র তাই হয়তো  একে রুদ্রপলাশ নামে ডাকা  সার্থক হয়েছে । উপযুক্ত আবহাওয়ায় হাওয়াই দ্বীপে সারা বছর ধরেই ফুটতে থাকে এই ফুল যার আরো কিছু অর্থবহ নাম আছে। 
 গাছের চূড়ায় অগ্নি শিখার মতো মনে হয় বলে একে ফ্লেমিং ট্রি বা ফ্লেম অফ দি ফরেস্ট বলা হয়, যা কৃষ্ণচূড়া  বা আরো কিছু গাছের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। এর একটি নাম ‘ফাউনটেন ট্রি’। এর ফুলের কুঁড়ির ভেতরে থাকে জল। বয়স তিন চার বছর হলেই ফুল ধরে গাছে, আর তখন সেগুলি বেশ নিচু থাকে বলে আফ্রিকার ছেলেমেয়েরা এই কুঁড়ি নিয়ে খেলার সুযোগ পায়। আগায় সামান্য ছিদ্র করে টিপে দিলে তীরবেগে বেরিয়ে আসে জল  যাকে তারা ব্যবহার খেলনা ‘ওয়াটার-গান” হিসেবে। এ ছাড়াও যখন ফুল ফোটে তখন সেগুলি জোড়া লাগা পাপড়ির কারণে বৃষ্টি বা শিশিরের জল ধারণ করে, যে জল ‘ফাউন্টেন’ থেকে পান করে পাখিরা।

  রুদ্রপলাশ পাখিদের জন্যে এটি একটি অনুপম আস্তানা। কিছু পাখি এর বীজ খায় যা দেখতে মনে হয় স্বচ্ছ কাগজের মধ্যে আটকানো একটি হার্ট। এই হার্ট দেখে মনে হয় কেউ যেন মার্কার পেন দিয়ে শেপটা যত্ন করে এঁকে দিয়েছে। এর নৌকোর মতো সিডপডের খোলে ৫০০ র মতো বীজ হয় যা হালকা হবার কারণে উড়ে যেতে পারে দূরে যেখান থেকে আবার নতুন গাছের জন্ম হয়। তবে কোনো কারণে এই গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হলে ‘সাকার রুট’ থেকে আবার নতুন গাছ তৈরি হতে পারে।
এর কাঠ খুব নরম। পোর্টো রিকোর একটি স্বাস্থ্যবান গাছ বছরে দুই ইঞ্চি করে বেড়ে যেতে পারে। আর এতো দ্রুত বেড়ে যায় বলে কাঠের ঘন হবার সুযোগ থাকে কম। কাঠ নরম হবার কারণে এর কাণ্ডের চাক খোদাই করে তৈরি হয় আদিবাসীদের বাদ্যযন্ত্রের খোল যা মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের দোকানেও পাওয়া যায়। গাছের ওপরের দিকের ডালে শাদা রঙের কিছু দাগ দেখা যায় যেগুলি লেন্টিসেল, এক ধরণের ছিদ্র যার ভেতর দিয়ে গাছের শ্বাস নেবার বন্দোবস্ত থাকে। এ গাছের পাতাগুলি যৌগিক। সংখ্যায় ৭ থেকে ১৭ যাই হোক কিনারের দিকে একটি পাতা অতিরিক্ত থাকবেই যে কারণে সব সময় এর পাতা হয় বিজোড় সংখ্যার। পাতার গোড়ায় ছোট ছোট দুচারটে গ্রন্থিও দেখা যায় যা একটু উঁচু হয়ে থাকে।
রুদ্রপলাশের নরম শরীরে বারবেট বা কাঠঠোকরা জাতীয় পাখি গর্ত করে বাসা তৈরি করে, বাচ্চা ওঠায়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, যেখানটায় গর্ত করে ঠিক তার নিচে বা আশেপাশেও কাঠের কোনো টুকরো পড়ে থাকতে দেখা যায় না। নিরাপত্তার কারণে, যাতে কোনো হিংস্র প্রাণি নীড়ের হদিস না পায় সেজন্যে কাঠের ছোট ছোট টুকরোগুলো তারা অনেক দূরে নিয়ে ফেলে দেয়। কিছু পাখি এই টুকরোগুলো খেয়েও ফেলে যা দূরে গিয়ে উগলে দেয়। বারবেটের জন্যে বাসা বানানো কোনো ব্যাপারই নয়, এক বাসা সে কখনো দুইবার ব্যবহার করে না, এসব পরিত্যক্ত বাসা তখন যেসব পাখি গর্ত করে বাসা তৈরি করতে পারে না তারাই ব্যবহার করে, যার মধ্যে রয়েছে কিছু টিয়া জাতীয় পাখি।
এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম স্প্যাথোডিয়া ক্যাম্পানিউলেটা (Spathodea Campanulata). এর ফুলের বৃতি বা ক্যালিক্স-এর আকৃতি কিছুটা বাঁকা স্পেড বা কোদালের মতো বলে জেনাস-এর এই নাম। আর ঘন্টা বা বাটির মতো বলে ক্যাম্পানিউলেটা। এই গণ-এ মাত্র একটি মাত্র উদ্ভিদই নজরে আসে। অস্ট্রেলিয়াতে হলুদ বা স্বর্ণাভ ফুলের একটি কাল্টিভার বা আবাদিত গাছ উদ্ভাবিত হয়েছে যাকে Spathodea companulata ‘Aurea’ নাম দেয়া হয়েছে।
আফ্রিকার গোল্ডকোস্টেই এই গাছ প্রথম চোখে পড়ে প্রকৃতিবিদদের। ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সুদান,‌ জাম্বিয়া ইত্যাদি আফ্রিকান দেশের নেটিভ গাছ হলেও ন্যাচারালাইজড্‌ বা পরিবেশানুগ হয়েছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপোর, আমেরিকার ফ্লোরিডা, হাওয়াই এবং অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও বেশ কিছু দেশে। হাওয়াই এবং অস্ট্রেলিয়াতে এদের উইড বা স্লিপার উইড (Sleeper Weed) হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ‘স্লিপার উইড’ বলতে বোঝায় সেই সব গাছ যা সুপ্ত অবস্থায় থাকে অনেক বছর তারপর বন্যা ক্ষরা অগ্নিকাণ্ড প্লাবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে অকস্মাৎ আত্মপ্রকাশ করে। অস্ট্রেলিয়ান উইডস কমিটি একে নজরে রাখছে।
এই গাছ কিছু শহরের রাস্তার ধারে বা বাগানে লাগানো হয়েছে সিঙ্গাপোর ফ্লোরিডা ইত্যাদি অঞ্চলে। বিশ ত্রিশ বছর পর প্রায়ই রোগগ্রস্ত হতে দেখা যায় এই গাছকে, ভেতরটা ফাঁপা হয়ে যায় এবং ডালপালা ঝড়ে ভেঙে পড়ে। এর শেকড়ও ভূমির উপরিভাগ দিয়ে ছড়িয়ে পড়তে চায়, এসব কারণে এদের সরাসরি কোনো বিল্ডিং বা ফুটপাথের পাশে লাগানো বিপজ্জনক। তবু ভারত-বাংলাদেশে এই গাছ তো আগ্রাসী নয়, নির্মল সৌন্দর্যের জন্যে কিছু রুদ্রপলাশ গাছ পার্কে বাগানে থাকলে কোনো ক্ষতি নেই, বরং এখানে তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে আমাদের শিল্প-মানসে সৌন্দর্য বিকিরণ করে।
তথ্যসুত্র ও ফটো -গুগল

৩টি মন্তব্য:

  1. খুব ভাল। তবে বাংলার বৃক্ষ গুলিকে এক সারিতে পাবো কি ?

    উত্তরমুছুন
  2. সত্যি অনবদ্য।আপনার কাছে এই রকম আরো শেয়ার আশা করছি। এই গাছের চারা কোলকাতার কোথায় পাওয়া যায় জানালে বাধিত হব।আলিপুর হটিকালচারে সব গাছের চারা খোজ করে পাই নি।ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন