রবিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৭

উদ্ভিদের ইন্দ্রিয় ও ভালোবাসা

ইদানিং অনুভবে বুঝতে পারি ,আমার গাছের সাথে আমার একটা আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছে যেটা যা শুধুই ছিল আমার সন্তান তিতলির সাথে। আমি খুব গভীরভাবে ভাবতে পারিনা , তবে আমার অনূভুতি দিয়ে বুঝি ভালোবাসার স্পর্শে আমার গাছ পাতা হেসে ওঠে, আমি রোজ একবার হলেও গাছের সাথে দেখা করি, কথা বলি । হয়ত ভাবছেন গাছের সাথে কথা বলা, এ আবার কেমন পাগলামি, গাছ কি আর আমাদের কথা বুঝতে পারে? আমার মনে হয় , শুনেছেন কখনও পায়ের তলায় চাপা পরে যাওয়া ঘাসগুলোর কান্নাভেজা কাকতি মিনতি, আমায় মাড়িয়ে যেওনা ।বাগানের কোনে ঐ যে পলাশ গাছটি দেখা যাচ্ছে ওটা কি ঘ্রান নিতে পারে? বা ওই যে গাদা ফুল গাছটি ওর কি আদৌ দৃষ্টি ক্ষমতা আছে? কখনো কখনো মনে হয় , আমি আসতে আসতে পাগল হয়ে যাচ্ছি বোধহয় !


এই কথাগুলি আমার ও বিশ্বাস হয়, গাছ ও ভালবাসতে পারে ,ভালোলাগা,আনন্দ,কস্ট সব আছে । কীভাবে পারে তা বিজ্ঞান আমাদের জানিয়ে দিয়েছে স্পষ্টভাবে,বাংলার কৃতী সন্তান, বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু দেখিয়েছেন মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মত গাছেরও অনুভূতি আছে। নিজের আবিষ্কৃত cresograph নামক যন্ত্রের সাহায্যে তিনি প্রমান করতে সক্ষম হয়েছেন মানুষের মত গাছও ব্যাথা অনুভব করে। আমরা যখন গাছের পাতা ছিঁড়ি কখনও কি ভেবেছি গাছের ভেতর কি অনুভূত হচ্ছে? তিনি দেখিয়েছেন যখন গাছের পাতা ছেঁড়া হয় তখন যে জায়গায় ছেঁড়া হল সেখানে সংবেদনশীলতা (impulse) কিছুক্ষনের জন্য থেমে যায়। আবার সংবেদন শুরু হয় তবে এবার খুব ধীরে এবং কিছুক্ষন পর তা পুরোপুরি থেমে যায়।
তিনি আরও দেখিয়েছেন বিশেষ শব্দ তরঙ্গ (যেমন শ্রুতিমধুর সঙ্গীত) গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অপরদিকে উচ্চ বা কর্কশ শব্দ গাছের বৃদ্ধি প্রতিহত করে। পরবর্তীতে ১৯৬০ দশকের দিকে Dr. Cleve Backster ও একই ধরনের ফলাফল অবহিত করেন। তিনি গাছের পাতার সাথে পলিগ্রাফ (lie detector) যন্ত্র সংযোগ করে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে গাছের বদ্যুতিক তরঙ্গের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। গাছের পাতাকে যখন গরম কফিতে চুবানো হোল পলিগ্রাফের রিডিং কমতে থাকল যেটা হতাশা আর দুঃখের নির্দেশক। অতঃপর তিনি গাছের পাশে দাড়িয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে গাছে আগুন লাগানোর অভিপ্রায় ভাবতে লাগলেন, তখন পলিগ্রাফ রিডিং হঠাৎ করে বেড়ে গেল। যেন গাছ মানুষের আভিপ্রায় বোঝার ক্ষমতা রাখে। ১৯৬২ সালের দিকে ভারতের আন্নামালিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক Dr. T. C. Singh দোপাটি ফুলের উপর সঙ্গীতের প্রভাব পরিক্ষা করে দেখান ক্লাসিকাল এবং রাগ সঙ্গিতের প্রভাবে গাছের বৃদ্ধি এবং ফলন বেশি হয় । তিনি আরও দেখিয়েছেন পিটুনিয়া এবং গাদা ফুল গাছ যখন ভারত নাট্টৈম জাতীয় নাচের কম্পনের সংস্পর্শে আনা হয় তখন গাছগুলোর ফুল দুই সপ্তাহ আগে ফোটে। ১৯৭৩ সালের দিকে Dorothy Retallack বেশ কয়েকটি গাছ নিয়ে ভিন্ন সঙ্গীত প্রয়োগ করেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন rock music গাছকে অস্বাভাবিক লম্বা আর পাতাগুলো ছোট করে দেয়। কলা গাছকে rock music শোনানোর ফলে গাছ গুলো মারা যায় । উনার এই সব তথ্য উনি The Sound of Music and Plants (1973) নামক বইয়ে প্রকাশ করেছেন । Country music গাছের বৃদ্ধির উপর কোন প্রভাব ফেলেনি। Jazz music শোনানোর ফলে গাছের বৃদ্ধি ভাল হয়েছিল।
গাছের ইন্দ্রিয় র কথা বলতে গিয়ে জগদীশ চন্দ্র তাঁর 'অব্যক্ত ' প্রবন্ধে গাছের জন্ম মৃত্যু ও অনুভবের কথা লিখেছিলেন , প্রবন্ধটির কিছুটা অংশ উল্লেখ করলাম ----
গাছের কথা
গাছেরা কি কিছু বলে? অনেকে বলিবেন, এ আবার কেমন প্রশ্ন? গাছ কি কোনো দিন কথা কহিয়া থাকে? মানুষেই কি সব কথা ফুটিয়া বলে? আর যাহা ফুটিয়া বলে না, তাহা কি কথা নয়? আমাদের একটি খোকা আছে, সে সব কথা ফুটিয়া বলিতে পারে না; আবার ফুটিয়া যে দুই চারিটি কথা বলে, তাহাও এমন আধো আধো ও ভাঙা ভাঙা যে, অপরের সাধ্য নাই তাহার অর্থ বুঝিতে পারে। কিন্তু আমরা আমাদের খোকার সকল কথার অর্থ বুঝিতে পারি। কেবল তাহা নয়। আমাদের খোকা অনেক কথা ফুটিয়া বলে না; চক্ষু, মুখ ও হাত নাড়া, মাথা নাড়া প্রভৃতির দ্বারা আকার ইঙ্গিতে অনেক কথা বলে, আমরা তাহাও বুঝিতে পারি, অন্যে বুঝিতে পারে না। একদিন পার্শ্বের বাড়ি হইতে একটি পায়রা উড়িয়া আসিয়া আমাদের বাড়িতে বসিল; বসিয়া গলা ফুলাইয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিল। পায়রার সঙ্গে খোকার নূতন পরিচয়; খোকা তাহার অনুকরণে ডাকিতে আরম্ভ করিল। 'পায়রা কি-রকম ভাবে ডাকে?' বলিলেই ডাকিয়া দেখায়; তদ্‌ভিন্ন সুখে দুঃখে, চলিতে বসিতে, আপনার মনেও ডাকে। নূতন বিদ্যাটা শিখিয়া তাহার আনন্দের সীমা নাই।
একদিন বাড়ি আসিয়া দেখি, খোকার বড়ো জ্বর হইয়াছে; মাথার বেদনায় চক্ষু মুদিয়া বিছানায় পড়িয়া আছে। যে দুরন্ত শিশু সমস্ত দিন বাড়ি অস্থির করিয়া তুলিত, সে আজ একবার চক্ষু খুলিয়াও চাহিতেছে না। আমি তাহার বিছানার পাশে বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলাম। আমার হাতের স্পর্শে খোকা আমাকে চিনিল, এবং অতি কষ্টে চক্ষু খুলিয়া আমার দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিল। তার পর পায়রার ডাক ডাকিল। ঐ ডাকের ভিতর আমি অনেক কথা শুনিলাম। আমি বুঝিতে পারিলাম, খোকা বলিতেছে, 'খোকাকে দেখিতে আসিয়াছ? খোকা তোমাকে বড়ো ভালোবাসে।' আরও অনেক কথা বুঝিলাম, যাহা আমিও কোনো কথার দ্বারা বুঝাইতে পারি না।
যদি বল, পায়রার ডাকের ভিতর এত কথা কি করিয়া শুনিলে? তাহার উত্তর এই, খোকাকে ভালোবাসি বলিয়া। তোমরা দেখিয়াছ, ছেলের মুখ দেখিয়া মা বুঝিতে পারেন ছেলে কি চায়। অনেক সময় কথারও আবশ্যক হয় না। ভালোবাসিয়া দেখিলেই অনেক গুণ দেখিতে পাওয়া যায়, অনেক কথা শুনিতে পাওয়া যায়।
আগে যখন একা মাঠে কিংবা পাহাড়ে বেড়াইতে যাইতাম, তখন সব খালি-খালি লাগিত। তার পর গাছ, পাখি, কীট পতঙ্গদিগকে ভালোবাসিতে শিখিয়াছি, সে অবধি তাদের অনেক কথা বুঝিতে পারি, আগে যাহা পারিতাম না। এই যে গাছগুলি কোনো কথা বলে না, ইহাদের আবার একটা জীবন আছে, আমাদের মতো আহার করে, দিন দিন বাড়ে, আগে এ সব কিছুই জানিতাম না। এখন বুঝিতে পারিতেছি। এখন ইহাদের মধ্যেও আমাদের মতো অভাব, দুঃখ-কষ্ট দেখিতে পাই। জীবনধারণ করিবার জন্য ইহাদিগকেও সর্বদা ব্যস্ত থাকিতে হয়। কষ্টে পড়িয়া ইহাদের মধ্যেও কেহ কেহ চুরি ডাকাতি করে। মানুষের মধ্যে যেরূপ সদ্‌গুণ আছে, ইহাদের মধ্যেও তাহার কিছু কিছু দেখা যায়। বৃক্ষদের মধ্যে একে অন্যের সাহায্য করিতে দেখা যায়, ইহাদের মধ্যে একের সহিত অপরের বন্ধুতা হয়। তার পর মানুষের সর্বোচ্চ গুণ যে স্বার্থত্যাগ, গাছে তাহাও দেখা যায়। মা নিজের জীবন দিয়া সন্তানের জীবন রক্ষা করেন। সন্তানের জন্য নিজের জীবন-দান উদ্ভিদেও সচরাচর দেখা যায়। গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়ামাত্র। ক্রমে এ সব কথা তোমাদিগকে বলিব।
তোমরা শুষ্ক গাছের ডাল সকলেই দেখিয়াছ। মনে কর, কোনো গাছের তলাতে বসিয়াছ। ঘন সবুজ পাতার গাছটি ঢাকা, ছায়াতে তুমি বসিয়াছ। গাছের নীচে এক পার্শ্বে একখানি শুষ্ক ডাল পড়িয়া আছে। এক সময় এই ডালে কত পাতা ছিল, এখন সব শুকাইয়া গিয়াছে, আর ডালের গোড়ায় উই ধরিয়াছে। আর কিছুকাল পরে ইহার চিহ্নও থাকিবে না। আচ্ছা, বলো তো এই গাছ আর এই মরা ডালে কি প্রভেদ? গাছটি বাড়িতেছে, আর মরা ডালটা ক্ষয় হইয়া যাইতেছে; একে জীবন আছে, আর অন্যটিতে জীবন নাই। যাহা জীবিত তাহা ক্রমশ বাড়িতে থাকে। জীবিতের আর একটি লক্ষণ এই যে, তাহার গতি আছে, অর্থাৎ তাহারা নড়ে চড়ে। গাছের গতি হঠাৎ দেখা যায় না। লতা কেমন করিয়া ঘুরিয়া গাছকে জড়াইয়া ধরে, দেখিয়াছ?
জীবিত বস্তুতে গতি দেখা যায়; জীবিত বস্তু বাড়িয়া থাকে। কেবল ডিমে জীবনের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। ডিমে জীবন ঘুমাইয়া থাকে। উত্তাপ পাইলে ডিম হইতে পাখির ছানা জন্মলাভ করে। বীজগুলি যেন গাছের ডিম; বীজের মধ্যেও এরূপ গাছের শিশু ঘুমাইয়া থাকে। মাটি, উত্তাপ ও জল পাইলে বীজ হইতে বৃক্ষশিশুর জন্ম হয়।
বীজের উপর এক কঠিন ঢাক্‌না; তাহার মধ্যে বৃক্ষ-শিশু নিরাপদে নিদ্রা যায়। বীজের আকার নানাপ্রকার, কোনোটি অতি ছোটো, কোনোটি বড়ো। বীজ দেখিয়া গাছ কত বড়ো হইবে বলা যায় না। অতি প্রকাণ্ড বটগাছ, সরিষা অপেক্ষা ছোটো বীজ হইতে জন্মে। কে মনে করিতে পারে, এত বড়ো গাছটা এই ক্ষুদ্র সরিষার মধ্যে লুকাইয়া আছে? তোমরা হয়তো কৃষকদিগকে ধানের বীজ ক্ষেতে ছড়াইতে দেখিয়াছ। কিন্তু যত গাছপালা, বন-জঙ্গল দেখ, তাহার অনেকের বীজ মানুষ ছড়ায় নাই। নানা উপায়ে গাছের বীজ ছড়াইয়া যায়। পাখিরা ফল খাইয়া দূর দেশে বীজ লইয়া যায়। এই প্রকারে জনমানবশূন্য দ্বীপে গাছ জন্মিয়া থাকে। ইহা ছাড়া অনেক বীজ বাতাসে উড়িয়া অনেক দূর দেশে ছড়াইয়া পড়ে। শিমুল গাছ অনেকে দেখিয়াছ। শিমুল-ফল যখন রৌদ্রে ফাটিয়া যায় তখন তাহার মধ্য হইতে বীজ তুলার সঙ্গে উড়িতে থাকে। ছেলেবেলায় আমরা এই সকল বীজ ধরিবার জন্য ছুটিতাম; হাত বাড়াইয়া ধরিতে গেলেই বাতাস তুলার সহিত বীজকে অনেক উপরে লইয়া যাইত। এই প্রকারে দিন-রাত্রি দেশ-দেশান্তরে বীজ ছড়াইয়া পড়িতেছে।
প্রত্যেক বীজ হইতে গাছ জন্মে কি না, কেহ বলিতে পারে না। হয়তো কঠিন পাথরের উপর বীজ পড়িল, সেখানে তার অঙ্কুর বাহির হইতে পারিল না। অঙ্কুর বাহির হইবার জন্য উত্তাপ, জল ও মাটি চাই।
যেখানেই বীজ পড়ুক না কেন, বৃক্ষ-শিশু অনেক দিন পর্যন্ত বীজের মধ্যে নিরাপদে ঘুমাইয়া থাকে। বাড়িবার উপযুক্ত স্থানে যতদিন না পড়ে, ততদিন বাহিরের কঠিন ঢাক্‌না গাছের শিশুটিকে নানা বিপদ হইতে রক্ষা করে।
ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বীজ পাকিয়া থাকে। আম, লিচুর বীজ বৈশাখ মাসে পাকে; ধান, যব ইত্যাদি আশ্বিন কার্তিক মাসে পাকিয়া থাকে। মনে কর, একটি গাছের বীজ আশ্বিন মাসে পাকিয়াছে। আশ্বিন মাসের শেষে বড়ো ঝড় হয়। ঝড়ে পাতা ও ছোটো ছোটো ডাল ছিঁড়িয়া চারিদিকে পড়িতে থাকে। এইরূপে বীজগুলি চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। প্রবল বাতাসের বেগে কোথায় উড়িয়া যায়, কে বলিতে পারে? মনে কর, একটি বীজ সমস্ত দিন-রাত্রি মাটিতে লুটাইতে লুটাইতে একখানা ভাঙা ইট কিংবা মাটির ডেলার নীচে আশ্রয় লইল। কোথায় ছিল, কোথায় আসিয়া পড়িল। ক্রমে ধূলা ও মাটিতে বীজটি ঢাকা পড়িল। এখন বীজটি মানুষের চক্ষুর আড়াল হইল। আমাদের দৃষ্টি হইতে দূরে গেল বটে, কিন্তু বিধাতার দৃষ্টির বাহিরে যায় নাই। পৃথিবী মাতার ন্যায় তাহাকে কোলে তুলিয়া লইলেন। বৃক্ষ-শিশুটি মাটিতে ঢাকা পড়িয়া বাহিরের শীত ও ঝড় হইতে রক্ষা পাইল। এইরূপে নিরাপদে বৃক্ষ-শিশুটি ঘুমাইয়া রহিল।
উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু
মৃত্তিকার নীচে অনেক দিন বীজ লুকাইয়া থাকে। মাসের পর মাস এইরূপে কাটিয়া গেল। শীতের পর বসন্ত আসিল। তারপর বর্ষার আরম্ভে দুই-এক দিন বৃষ্টি হইল। এখন আর লুকাইয়া থাকিবার প্রয়োজন নাই। বাহির হইতে কে যেন শিশুকে ডাকিয়া বলিতেছে, 'আর ঘুমাইয়ো না, উপরে উঠিয়া আইস, সূর্যের আলো দেখিবে।' আস্তে আস্তে বীজের ঢাক্‌নাটি খসিয়া পড়িল, দুইটি কোমল পাতার মধ্য হইতে অঙ্কুর বাহির হইল। অঙ্কুরের এক অংশ নীচের দিকে গিয়া দৃঢ়রূপে মাটি ধরিয়া রহিল, আর এক অংশ মাটি ভেদ করিয়া উপরে উঠিল। তোমরা কি অঙ্কুর উঠিতে দেখিয়াছ? মনে হয় শিশুটি যেন ছোটো মাথা তুলিয়া আশ্চর্যের সহিত নূতন দেশ দেখিতেছে।
গাছের অঙ্কুর বাহির হইলে যে অংশ মাটির ভিতর প্রবেশ করে, তাহার নাম মূল। আর যে অংশ উপরের দিকে বাড়িতে থাকে, তাহাকে বলে কাণ্ড। সকল গাছেই 'মূল' আর 'কাণ্ড' এই দুই ভাগ দেখিবে। এই এক আশ্চর্যের কথা, গাছকে যেরূপেই রাখ, মূল নীচের দিকে ও কাণ্ড উপরের দিকে যাইবে। একটি টবে গাছ ছিল। পরীক্ষা করিবার জন্য কয়েক দিন ধরিয়া টবটিকে উল্টা করিয়া ঝুলাইয়া রাখিলাম। গাছের মাথা নীচের দিকে ঝুলিয়া রহিল, আর শিকড় উপরের দিকে রহিল। দুই-এক দিন পরে দেখিতে পাইলাম যে, গাছ যেন টের পাইয়াছে। তাহার সব ডালগুলি বাঁকা হইয়া উপরের দিকে উঠিল ও মূলটি ঘুরিয়া নীচের দিকে নামিয়া গেল। তোমরা অনেকে শীতকালে অনেক বার মূলা কাটিয়া শয়তা করিয়া থাকিবে। দেখিয়াছ, প্রথমে শয়তার পাতাগুলি ও ফুল নীচের দিকে থাকে। কিছুদিন পরে দেখিতে পাওয়া যায়, পাতা ও ফুলগুলি উপর দিকে উঠিয়াছে।
আমরা যেরূপ আহার করি, গাছও সেইরূপ আহার করে। আমাদের দাঁত আছে, আমরা কঠিন জিনিস খাইতে পারি। ছোটো ছোটো শিশুদের দাঁত নাই; তাহারা কেবল দুধ খায়। গাছেরও দাঁত নাই, সুতরাং তাহারা কেবল জলীয় দ্রব্য কিংবা বাতাস হইতে আহার গ্রহণ করিতে পারে। মূল দ্বারা মাটি হইতে গাছ রস শোষণ করে। চিনিতে জল ঢালিলে চিনি গলিয়া যায়। মাটিতে জল ঢালিলে মাটির ভিতরের অনেক জিনিস গলিয়া যায়। গাছ সেই সব জিনিস আহার করে। গাছের গোড়ায় জল না দিলে গাছের আহার বন্ধ হইয়া যায়, ও গাছ মরিয়া যায়।
অনুবীক্ষণ দিয়া অতি ক্ষুদ্র পদার্থ দেখিতে পাওয়া যায়। গাছের ডাল কিংবা মূল এই যন্ত্র দিয়া পরীক্ষা করিলে দেখা যায় যে, গাছের মধ্যে হাজার হাজার নল আছে। এইসব নল দ্বারা মাটি হইতে গাছের শরীরে রস প্রবেশ করে।
এ ছাড়া গাছের পাতা বাতাস হইতে আহার সংগ্রহ করে। পাতার মধ্যে অনেকগুলি ছোটো ছোটো মুখ আছে। অণুবীক্ষণ দিয়া এই সব মুখে ছোটো ছোটো ঠোঁট দেখা যায়। যখন আহার করিবার আবশ্যক হয় না তখন ঠোঁট দুইটি বুজিয়া যায়। আমরা যখন শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করি তখন প্রশ্বাসের সঙ্গে এক প্রকার বিষাক্ত বায়ু বাহির হইয়া যায়; তাহাকে অঙ্গারক বায়ু বলে। ইহা যদি পৃথিবীতে জমিতে থাকে তবে সকল জীবজন্তু অল্পদিনের মধ্যে এই বিষাক্ত বায়ু গ্রহণ করিয়া মরিয়া যাইতে পারে। বিধাতার করুণার কথা ভাবিয়া দেখ। যাহা জীবজন্তুর পক্ষে বিষ, গাছ তাহাই আহার করিয়া বাতাস পরিষ্কার করিয়া দেয়। গাছের পাতার উপর যখন সূর্যের আলোক পড়ে, তখন পাতাগুলি সূর্যের তেজের সাহায্যে অঙ্গারক বায়ু হইতে অঙ্গার বাহির করিয়া লয়। এই অঙ্গার গাছের শরীরে প্রবেশ করিয়া গাছকে বাড়াইতে থাকে। গাছেরা আলো চায়, আলো না হইলে ইহারা বাঁচিতে পারে না। গাছের সর্বপ্রধান চেষ্টা, কি করিয়া একটু আলো পাইবে। যদি জানালার কাছে টবে গাছ রাখ, তবে দেখিবে, সমস্ত ডালগুলি অন্ধকার দিক্‌ ছাড়িয়া আলোর দিকে যাইতেছে। বনে যাইয়া দেখিবে, গাছগুলি তাড়াতাড়ি মাথা তুলিয়া কে আগে আলোক পাইতে পারে, তাহার চেষ্টা করিতেছে। লতাগুলি ছায়াতে পড়িয়া থাকিলে আলোর অভাবে মরিয়া যাইবে, এইজন্য তাহারা গাছ জড়াইয়া ধরিয়া উপরের দিকে উঠিতে থাকে।
এখন বুঝিতে পারিতেছ, আলোই জীবনের মূল। সূর্যের কিরণ শরীরে ধারণ করিয়াই গাছ বাড়িতে থাকে। গাছের শরীরে সূর্যের কিরণ আবদ্ধ হইয়া আছে। কাঠে আগুন ধরাইয়া দিলে যে আলো ও তাপ বাহির হয়, তাহা সূর্যেরই তেজ। গাছ ও তাহার শস্য আলো ধরিবার ফাঁদ। জন্তুরা গাছ খাইয়া প্রাণ ধারণ করে; গাছে যে সূর্যের তেজ আছে তাহা এই প্রকারে আবার জন্তুর শরীরে প্রবেশ করে। শস্য আহার না করিলে আমরাও বাঁচিতে পারিতাম না। ভাবিয়া দেখিতে গেলে, আমরাও আলো আহার করিয়া বাঁচিয়া আছি।
কোনো কোনো গাছ এক বৎসরের পরেই মরিয়া যায়। সব গাছই মরিবার পূর্বে সন্তান রাখিয়া যাইতে ব্যগ্র হয়। বীজগুলিই গাছের সন্তান। বীজ রক্ষা করিবার জন্য ফুলের পাপড়ি দিয়া গাছ একটি ক্ষুদ্র ঘর প্রস্তুত করে। গাছ যখন ফুলে ঢাকিয়া থাকে, তখন কেমন সুন্দর দেখায়। মনে হয়, গাছ যেন হাসিতেছে। ফুলের ন্যায় সুন্দর জিনিস আর কি আছে? গাছ তো মাটি হইতে আহার লয়, আর বাতাস হইতে অঙ্গার আহরণ করে। এই সামান্য জিনিস দিয়া কি করিয়া এরূপ সুন্দর ফুল হইল? গল্পে শুনিয়াছি, স্পর্শমণি নামে এক প্রকার মণি আছে, তাহা ছোঁয়াইলে লোহা সোনা হইয়া যায়। আমার মনে হয়, মাতার স্নেহই সেই মণি। সন্তানের উপর ভালোবাসাটাই যেন ফুলে ফুটিয়া উঠে। ভালোবাসার স্পর্শেই যেন মাটি এবং অঙ্গার ফুল হইয়া যায়।
গাছে ফুল ফুটিয়া রহিয়াছে দেখিলে আমাদের মনে কত আনন্দ হয়! বোধ হয় গাছেরও যেন কত আনন্দ! আনন্দের দিনে আমরা দশজনকে নিমন্ত্রণ করি। ফুল ফুটিলে গাছও তাহার বন্ধু-বান্ধবদিগকে ডাকিয়া আনে। গাছ যেন ডাকিয়া বলে 'কোথায় আমার বন্ধু-বান্ধব, আজ আমার বাড়িতে এসো। যদি পথ ভুলিয়া যাও, বাড়ি যদি চিনিতে না পার, সেজন্য নানা রঙের ফুলের নিশান তুলিয়া দিয়াছি। এই রঙিন পাপড়িগুলি দূর হইতে দেখিতে পাইবে।' মৌমাছি ও প্রজাপতির সহিত গাছের চিরকাল বন্ধুতা। তাহারা দলে দলে ফুল দেখিতে আসে। কোনো কোনো পতঙ্গ দিনের বেলায় পাখির ভয়ে বাহির হইতে পারে না। পাখি তাহাদিগকে দেখিলেই খাইয়া ফেলে। কাজেই রাত্রি না হইলে তাহারা বাহির হইতে পারে না। সন্ধ্যা হইলেই তাহাদিগকে আনিবার জন্য ফুল চারি দিকে সুগন্ধ বিস্তার করে।
গাছ ফুলের মধ্যে মধু সঞ্চয় করিয়া রাখে। মৌমাছি ও প্রজাপতি সেই মধু পান করিয়া যায়। মৌমাছি আসে বলিয়া গাছেরও উপকার হয়। ফুলে তোমরা রেণু দেখিয়া থাকিবে। মৌমাছিরা এক ফুলের রেণু অন্য ফুলে লইয়া যায়। রেণু ভিন্ন বীজ পাকিতে পারে না।
এইরূপে ফুলের মধ্যে বীজ পাকিয়া থাকে। শরীরের রস দিয়া গাছ বীজগুলিকে লালনপালন করিতে থাকে। নিজের জীবনের জন্য এখন আর মায়া করে না। তিল তিল করিয়া সন্তানের জন্য সমস্ত বিলাইয়া দেয়। যে শরীর কিছু দিন পূর্বে সতেজ ছিল, এখন তাহা একেবারে শুকাইয়া যাইতে থাকে। শরীরের ভার বহন করিবারও আর শক্তি থাকে না। আগে বাতাস হু-হু করিয়া পাতা নড়াইয়া চলিয়া যাইত। পাতাগুলি বাতাসের সঙ্গে খেলা করিত; ছোটো ডালগুলি তালে তালে নাচিত। এখন শুষ্ক গাছটি বাতাসের ভর সহিতে পারে না। বাতাসের এক-একটি ঝাপ্‌টা লাগিলে গাছটি থর-থর করিয়া কাঁপিতে থাকে। একটি একটি করিয়া ডালগুলি ভাঙিয়া পড়িতে থাকে। শেষে একদিন হঠাৎ গোড়া ভাঙিয়া গাছ মাটিতে পড়িয়া যায়।
এইরূপে সন্তানের জন্য নিজের জীবন দিয়া গাছ মরিয়া যায়।"
গাছের দর্শনানুভুতি ঃ-
আমাদের চোখে যেমন আলোক সংবেদনশীল প্রোটিন (photoreceptor proteins) আছে গাছেও তেমনি আছে আলোক সংবেদনশীল প্রোটিন। গাছের ডালের অগ্রভাগের কোষ গুলোতে phototropin নামক প্রটিন বিদ্যমান থাকে। এই ফটোট্রপিন নীল রশ্মি অনুভব করে সাংকেত ধারার (signal cascade) সৃষ্টি করে যা আক্সিন নামক হরমনের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে। অক্সিনের সক্রিয়তার ফলে ডালের যে পাশে ছায়া থাকে সে পাশের কোষ গুল প্রলম্বিত হয় ফলে ডালটি আলোর দিকে ধাবিত হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে গাছও দেখতে পায়।
গাছের স্পর্শানুভুতি ঃ-
স্পৃশ্য জগতে বৃক্ষের বসবাস। ডালপালা বাতাসে দোল খায়, পোকামাকড় পাতার উপর হেঁটে বেড়ায়, লতা অবলম্বনের সন্ধানে চারিদিক খুজে বেড়ায়। বৃক্ষের স্পর্শ বোধ তুলে ধরার জন্য ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ একটা ভাল উদাহারন। জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব উর্জবার্গের বিজ্ঞানীরা উদ্ঘাটন করেছেন ভয়ঙ্কর এ গাছটি সম্পর্কে নতুন একটি তথ্য। তারা জানান, ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের চুলটানা রেখার পাতায় যখন কোনো পোকা স্পর্শ করে তখন ফ্লাইট্র্যাপ স্পর্শগুলো গুণতে পারে। এরা বুঝতে পারে যার স্পর্শ পেলো তা ভোজ্য উপকরণ নাকি মিথ্যা সংকেত। ফলে যখন এক, দুই, তিন করে পাঁচবার কোনো উদ্দীপক অর্থাৎ, কীটপতঙ্গ তার পাতায় স্পর্শ করে তখন সে উদ্দীপকের উপর পাচক রস ক্ষরণ করে শুষে নেয় ও অবশিষ্টাংশ ফেলে দেয়।যখন কোন পোকামাকড় পাতারুপী ফাঁদের সংবেদনশীল রোম (trigger hair) গুলোকে স্পর্শ করে তখন সূচালো কাটাগুলো চট করে খাঁজে খাঁজে আবদ্ধ হয়ে শিকারটিকে আটকিয়ে ফেলে। ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ যে প্রক্রিয়াতে তার শিকারকে অনুভব করে তা হাতের ওপর মাছির উপস্থিতি উপলব্ধি করার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আমাদের চর্মে অবস্থিত Touch receptors গুলো মাছির উপস্থিতিতে বৈদ্যুতিক চাপ উৎপন্ন করে যা নার্ভের মাধ্যমে মস্তিস্কে পৌঁছে। মস্তিস্ক তখন রেস্পন্স সিগন্যাল পাঠায়। ফলে আমরা মাছিটাকে তাড়িয়ে দেই। অনুরুপ ভাবে যখন কোন পোকা ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপের রোমগুলোর সংস্পর্শে আসে তখন পাতায় উৎপন্ন বৈদ্যুতিক চাপ পাতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাতাকে দ্রুত বন্ধ করে দেয়।
গাছের গন্ধ অনুভুতি ঃ-
দেখা যাক এবার গাছ কিভাবে গন্ধ নেয়। স্বর্নলতাকে উদ্ভিদ জগতের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গন্ধ সনাক্তকারী কুকুরের সাথে তুলনা করা যায়। পরজিবী বিধায় স্বর্নলতাকে খাবারের জন্য অন্য উদ্ভিদের উপর জন্মাতে হয়। গাছটি গন্ধ শুঁকে আশ্রয়ী উদ্ভিদকে খুজে বের করে এবং বৈরী উদ্ভিদ থেকে দূরে থাকে। স্বর্নলতা গন্ধের ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল। অন্যান্য উদ্ভিদ এত সংবেদনশীল না হলেও কম বেশি সংবেদনশীল। প্রানীকুলে নাকের গন্ধসংবেদনশীল কোষ গুলো বাতাসে বাহিত এরমা অণুগুলো সনাক্ত করতে পারে। গাছে গন্ধ সংবেদনশীল রেসেপটার (receptor) আছে যারা বাতাসের উদ্বায়ী গন্ধ অণুগুলোকে সনাক্ত করতে পারে। ১৯২০ সালের দিকে USDA এর বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন ইথাইলিন (ethylene) গ্যাস কিভাবে ফলের পাক ধরাতে সহায়তা করে। ফল পাকার সময় ঘনিয়ে এলে ফল এই গ্যাস নির্গত করে নিজে পাকে এবং পাশবর্তী ফলকে পাকায় । Ethylene একটি উদ্ভিদ হরমোন যেটা ফল পাকানোর পাশাপাশি আরও কিছু কাজ করে থাকে। হেমন্তে গাছের পাতার রঙ বদলানো তার মধ্যে অন্যতম। গন্ধ নির্গত করে গাছ শত্রুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে এবং যোগাযোগ বজায় রাখে।
গাছের স্বাদ অনুভুতি ঃ-
এবার স্বাদের কথায় আসা যাক। স্বাদ এবং গন্ধ মিলে মিশে খাবারের প্রতি আমাদের রুচিকে প্রভাবিত করে। আমরা যখন খাবার চিবাই তখন সাথে সাথে খবারের গন্ধও পাই। স্বাদ ভাল হলেও যদি গন্ধ ভাল না হয় আমরা খেতে অনীহা দেখাই। স্বাদ ও গন্ধের মধ্যে মুলগত পার্থক্য হল স্বাদ তরল পদার্থকে সনাক্ত করে আর গন্ধ করে উদ্বায়ী পদার্থকে। মিথাইল জেসমনেট (methyl jasmonate) নামক একটি রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে স্বাদের ব্যাপারটা বোঝানর চেষ্টা করা যাক। এই গ্যাসটি যখন পত্ররন্ধ্রের (stomata) মধ্য দিয়ে বিস্তৃত হয় তখন এটা দ্রবণীয় জেসমনিক এসিডে (Jasmonic acid) রূপান্তরিত হয়। এই জেস্মনিক এসিড কোষের রেছেপটর (receptor) অনুগুলোকে উদ্দিপ্ত করে গাছের প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলে। স্বাদের কথা বলতে গেলে শেকড়ের কথা না বললেই নয়। গাছ শেকরের সাহায্যে মাটি থেকে দ্রবণীয় খাবার গ্রহন করে থাকে। যেহেতু কোন দ্রব্যের স্বাদ অনুভব করতে দ্রব্যটির তরল অবস্থায় রুপান্তর আবশ্যক তাই যৌক্তিক ভাবে বলা যায় যে গাছের স্বাদ অনভুতির অনেকখানিই শিকড়ে বিরাজমান । পরীক্ষা করে দেখা গেছে গাছের কোন এক সারিতে যখন খরার সৃষ্টি করা হয় তখন আশ্চর্যযনক ভাবে এই গাছ গুলোর অনতিদূরে অবস্থিত গাছ গুলোর পত্ররন্ধ্র (stomata) বন্ধ হয়ে যায়। খরা আক্রান্ত গাছগুলো অনতিদুরবর্তী গাছ গুলোর শিকড়ে দ্রবণীয় সঙ্কেত পাঠিয়ে গাছগুলোর পত্ররন্ধ্র বন্ধ করে দিয়ে গাছের জলীয় ভাগের অপচয় হ্রাস করে। খরায় বেঁচে থাকার এই সুনিপুণ কৌশল কি বলে দেয়না যে গাছও একটি বুদ্ধিদীপ্ত জীব।
গাছের শ্রবনানুভুতি ঃ-
গাছের শ্রবণ শক্তিও বেশ প্রখর! শব্দ তরঙ্গ দ্বারা গাছ নিজেদের মধ্যে সংকেত আদান প্রদান করে। সুইজারল্যান্ড এর Institute of Plant Science এর বিজ্ঞানীরা খরার সময় পাইন এবং ওক গাছ থেকে বিচ্ছুরিত শব্দ কম্পন রেকর্ড করেছেন। তাদের ধারণা এই শব্দ কম্পন দ্বারা গাছ নিকটবর্তী অন্যান্য গাছ গুলোকে খরার সংকেত দিয়ে আসছে। University of Missouri থেকে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন ক্যাটারপিলার গাছের পাতা খাওয়ার সময় যে শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে ঠিক সেরকম শব্দ তরঙ্গ যদি কৃত্রিম ভাবে গাছকে প্রেরন করা হয় তাহলে ঐ গাছগুলোতে কীটনাশক রাসায়নিক দ্রব্যের আধিক্য দেখা দেয় । অন্যদিকে যে গাছগুলোকে এই শব্দ তরঙ্গ দেয়া হয় নাই সেগুলোতে ঐ রাসায়নিক পদার্থের কোন পরিবর্তন হয় না। তাদের অভিমতে এই বিশেষ শব্দ তরঙ্গ গাছের এক বিশেষ রেসেপটার (receptor) দ্বারা সনাক্ত হয়ে গাছের defense mechanism কে সক্রিয় করে কীটনাশক পদার্থের সৃষ্টি করে। বিষাক্ত রাসায়নিক কীটনাশক ব্যাবহারের পরিবর্তে আমরা এমন একটা পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সচেষ্ট হতে পারি যেখানে কৃত্রিম উপায়ে এই শব্দ তরঙ্গ ক্ষেতের ফসলে প্রয়োগ করে পোকার আক্রমন থেকে ফসলকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। আর গাছের সঙ্গীতপ্রীতি আমরা এই প্রবন্ধের শুরুতে আলোকপাত করেছি।
গাছ প্রতিনিয়ত পত্র মেলে, ফূল ফুটিয়ে আর ফল ধরিয়ে আমাদের অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে যায়, মনকে উজ্জীবিত করে,মন খুশি তে ভরিয়ে দেয়,ভালবাসতে শেখায়, গাছর ছোঁয়াতেই হয়ত কিছুটা হলেও দুঃখকষ্ট, শোক ভুলে থাকা যায়।
ফুলের রঙের বাহারে রুপে,গন্ধে আমরা মুগ্ধ হই কিন্তু কখনও হয়ত ভাবিনি এই নিরীহ বৃক্ষরাজিরও একটা অনভুতির জগৎ আছে।প্রকৃতপক্ষে গাছের এই অনুভুতি তার বেঁচে থাকার জন্যই হয়ত জরুরী । গাছ শিকড় দিয়ে মাটি আঁকড়ে পরে থাকে। এরা খাদ্যের সন্ধানে হেঁটে বেড়াতে পারেনা, দৌড়ে পালিয়ে মানুশ,পশুপক্ষী ও পঙ্গপাল এবং অন্যান্য পোকামাকড় হাত থেকে বাঁচতেও পারে না। তবু আমি বিশ্বাস করি সব গাছেরই চোখ, কান, নাক, মুখ এবং চর্ম না থাকলেও গাছেরও যে আমাদের মতই নিজস্ব ইন্দ্রিয় আছে।
আগেই বলেছি সুযোগ পেলেই নিঝুম দুপুরে বাগানে বসে আমি আমার অনুভব দিয়ে আমার গাছের সাথে কথা বলি । আর রাতে আমার ছাদে একটু হলেও সময় কাটাই ওদের সাথে ...।। যখন তিতলির জন্য বুকটা হু হু করে ওঠে তখন অনুভব করি ,আমার তিতলি মায়ের প্রিয় গাছেরা মাথা দুলিয়ে ফিসফিস করে বলে , 'কাঁদছ কেন, আমরা তো আছি '.....😢😢🍀🥀🌺🌺🥀🥀
তথ্য সহায়তা --ভাত্রিপ্রতিম অধ্যাপক অর্নিবান মিত্র ও জনাব মহবুব চৌধুরী ।
গ্রন্থঋন -- How Acharya Jagadish Chandra Bose proved plants have life 115 years ago
জগদীশ রচনা ও প্রবন্ধাবলী

সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৭

বিদেশী ফুলের গুচ্ছ / Bidesi Phulera Guccha

ফুল ও গাছ ভালোবাসেন না এমন মানুষ সত্যি ই বিরল ।এই নিয়ে আমার একটা মজার গল্প বলি ।
আগেই বলেছি আমাদের বাড়ি 'অঙ্কার ধাম' এর বাগান সেই বাবার আমল থেকে, ছোটবেলা থেকে ফুল আর পাখিদের মধ্যেই বড় হয়েছি। ৭৭ কি ৭৮ সাল হবে , আমার মাসির বিয়ে হল , মাসি ও নতুন মেসোমশায় আমাদের বাড়িতে এসেছেন , অত্যন্ত ভদ্র মানুষ, সরকারী চাকুরি করেন । বাবা অফিসে , ছুটির দিন ,বাগানে ঘোরাঘুরি করছি ,মেসোমশাই ঘুরে ঘুরে বাগান দেখছেন , আমাকে বললেন , ""আচ্ছা এত ফুলগাছ, তোমরা কি গাছ বিক্রি কর " ? আমি বললাম না না ,এ সবই শখের ,সৌন্দর্যের জন্য ,( প্রসঙ্গত জানাই ,তখন পাড়ায় পাড়ায় এত নার্সারীর চল ছিল না) । আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নতুন মেসোমশাই বললেন ," সুন্দর ! টাকার চেয়ে সুন্দর জিনিষ আর কিছু হয় না। এ সব গাছ বিক্রির চেষ্টা কর ,তাতে ভালো হবে , না হলে এভাবে সময় নস্ট করে কোনো লাভ নেই" 😀😁😁
আমি হতভম্ব !!! আমি এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি !!! আজ এই প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে সেই অদ্ভুত মানুষটার কথা মনে পরায় এই 'ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেললাম' ।
যুগ যুগ ধরে 'শক হুন দল পাঠান মোঘল' দের ও বিভিন্ন বিদেশী বনিক ও সবুজপ্রেমীদের হাত ধরে নানা গাছ ও ফুল এসেছে 'সুজলা সুফলা শস্য স্যামলা' আমাদের এই বাংলায় ।অনুকূল ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুর সুবাদে বাংলা একটি উদ্ভিদসমৃদ্ধ অঞ্চল। অধিকন্তু হিমালয়, বর্মা-মালয় ও পূর্ব-ভারতের উদ্ভিদজগতের মিলনস্থল বিধায় এখানে প্রজাতির সংখ্যা ও বৈচিত্র্য অনেক। যুগ যুগ ধরে এমন সমৃদ্ধ প্রকৃতির মাঝখানে বসবাসকারী বাংলার মানুষ স্বভাবতই উদ্ভিদঘনিষ্ঠ ও পুষ্পপ্রেমিক, আর সেই সাক্ষ্য আছে বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্য, লোকগাথা ও লোকগীতিতে, এমনকি তাম্রলিপিতেও। হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগে পূজা-অর্চনার জন্য ফুলের যোগান দিতে নিশ্চিতই বাগান ছিল গৃহাঙ্গন ও মন্দিরে, ধ্যানার্থীর তপোবনে এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য রাজন্য ও অভিজাতদের প্রাসাদে। এসব ফুলের সবই ছিল দেশজ ও বনজ। আজও আমাদের পাহাড় ও বনাঞ্চলে অনেক প্রজাতির ফুল আছে যেগুলি বাগানে লাগানো যায়। তবে মুগলরাই ভারতে প্রথম সংগঠিত ও নির্দিষ্ট নকশার উদ্যানরীতি প্রবর্তন করেন। তারাই এদেশে আনেন মধ্যপ্রাচ্যের গাছপালা (চিনার, গোলাপ, লিলি ইত্যাদি)। ঔপনেবিশক শাসনামলে পাশ্চাত্য প্রভাবাধীন হওয়ায় এদেশে মুগলশৈলীর উদ্যানের কোন বিবর্তন আর ঘটে নি। আজও ভারতীয় উদ্যান বলতে মুগল উদ্যানই বোঝায়।
এদেশের বাগানের গাছপালার সিংহভাগই বিদেশী। এগুলি এনেছেন রাজা-বাদশা, পরিব্রাজক, বণিক, উপনিবেশিক শাসক ও তাদের কর্মচারীরা। এদেশের বাগানের ফুলগুলির মধ্যে মায়ানমার ও মালয় ছাড়া আছে চীন, জাপান, আফ্রিকা ও ক্রান্তীয় আমেরিকার বহু প্রজাতি। পরিচিতির সুবিধার্থে এগুলিকে বৃক্ষ, গুল্ম, লতা, কন্দীয়-মূলীয় ও মৌসুমি ঔষধিতে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়।
বৃক্ষ পুষ্পবৃক্ষ সাধারণত লাগানো হয় পার্ক, বড় বাগান, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যালয়ের চত্বরে। সুশ্রী পাতা, রঙিন প্রস্ফুটন ও মধুর গন্ধের জন্য এগুলি আকর্ষণীয়। উল্লেখযোগ্য বৃক্ষ: শিরীষ (Albizia lebbek, Parrot tree), ছাতিম (Alstonia scholaris, Devit’s tree), কদম (Anthocphalus chinensis, Kadamba), দেবকাঞ্চন (Bauhinia purpurea, Mountain ebony), রক্তকাঞ্চন (B. variegata, Purple orchid tree), শিমুল (Bombax ceiba, Red silk-cotton tree), পলাশ (Butea monosperma, Flame of the forest), বটলব্রাস (Callistemon citrinus), সোনালু সোনাইল/কর্ণিকার (Cassia fistula, Indian laburnum), লাল সোনাইল (C. javanica), মিনজিরি (C. siamea, Kassod tree), নাগলিঙ্গম (Couroupita guianensis, Cannonball tree), বরুণ (Crataeva nurvala, Caper tree), কৃষ্ণচূড়া (Delonix regia, Peacock flower), গ্লিরিসিডিয়া (Gliricidia sepium, Madre D’caeae), কুরচি/কূটজ/গিরিমল্লিকা (Holarrhena antidysenterica, Easter flower), জারুল (Lagerstroemia speciosa, Pride of India, Queen of flowers), বিলাতী জারুল (L. thorellii), হিমচাঁপা/উদয়পদ্ম (Magnolia grandifloara, Laural magnolia), নাগেশ্বর (Mesua nagassarium, Ironwood tree), স্বর্ণচাপা (Michelia champaca, Golden champa), বকুল (Mimusops elengi, Indian medlar), শেফালী (Nyctanthes arbor-tristis, Coral jasmine), পেল্টোফরাম (Peltophorum pterocarpum, Rusty shield bearer), কাঠগোলাপ/গৌরচাঁপা/গোলকচাঁপা, গোলাচি (Plumeria spp., Frangipani), অশোক (Saraca asoca), কলকে (Thevetia peruviana, Yellow oleander)।
এগুলি ছাড়াও অনেক বাগানে দেখা যায় অপেক্ষাকৃত কিছু দুষ্প্রাপ্য প্রজাতি: Amherstia nobilis (Tree of Heaven), Brownea coccinea (Scarlet flame bean), পুন্নাগ/সুলতান চাঁপা (Calophyllum inophyllum, Aleksandrian laurel), স্কারলেট কর্ডিয়া (Cordia sebenstena, Scarlet cordia), গুস্তাভিয়া (Gustavia augusta, Stink wood), পলকজুঁই Ixora paviflora, Torch tree), জ্যাকারান্ডা (Jacaranda mimosifolia, Jacaranda), মিলেসিয়া (Milletia peguensis, Jewels on a string), আকাশনীম/হিমঝুরি (Millingtonia hortensis, Indian cork tree), কনকচাঁপা/রামধনচাঁপা (Ochna squarrosa, Ramdhan champa), রুদ্রপলাশ (Spathodea companulata, African tulip tree), পরশপিপুল (Thespesia populnea, Portia tree)।
গুল্ম এগুলি গোড়া থেকে শাখায়িত, সাধারণত চিরসবুজ ও বহুবর্ষজীবী, ছোট-বড় সবধরণের বাগানেই লাগানো হয়। বাগান সজ্জার এই প্রধান উপকরণগুলির মধ্যে আছে: শিবঝুল/শিবজটা (Acalypha hispida, Cat’s tail), ঘণ্টাফুল (Allamanda nerifolia), ঝিন্টি কুরুবক (Barleria cristata Philipine violet), স্বর্ণঝিন্টি (B. prionitis), কাঞ্চন (Bauhinia acuminata, Orchid tree), রাধাচূড়া (Caesalpina pulcherrima, Peacock flower), হাসনাহেনা (Cestrum nocturnum, Queen of the night), ধুতরা (Datura fastuosa, Thorn apple), লালপাতা (Euphorbia pulcherrima, Poinsettia, Christmas flower), পাতাবাহার (Codiaeum variegatum, croton), গন্ধরাজ (Gardenia jasminoides, Cape Jasmine), জবা (Hibiscus rosa-sinensis, Chinarose), স্থলপদ্ম (H. mutabilis, Changable rose), লাল রঙ্গন (Ixora coccinea), হলুদ রঙ্গন (I. lutea), গোলাপী রঙ্গন (I. rosea), সিঙ্গাপুরী রঙ্গন (I. singapurensis), কুন্দ (Jasminum pubescens), বেলী (J. sambae, Arabian jasmine), ফুরুস (Lagerstroemia indica, Crape myrtle), গুয়েগাঁদা (Lantana camara), লঙ্কা জবা (Malvaviscus arboreus), সন্ধ্যামালতী/সন্ধ্যামণি (Mirabilis jalapa, Marvel of peru), কামিনী (Murrya exotica, Chinese box), নাগবল্লী (Mussaenda frondosa, M. erythrophylla, M. lutela), রক্তকরবী (Nerium oleander, Oleander), গোলাপ (Rosa spp.), টগর (Tabernaemontana coroneria, Cape jasmine), নয়নতারা (Vinca rosea, Periwinkle).
অপেক্ষাকৃত দুষ্প্রাপ্য গুল্মের মধ্যে রয়েছে: লাল ঘণ্টাফুল (Allamanda violocea), ছোট ঘণ্টাফুল (A, shottie), ব্রুনফেলসিয়া (Brunfelsia calycina, Yesterday-today-tomorrow), কেলিস্টেমন (Callistemon brevipes, C. haematocephata), রাজঘন্টা (Datura suaveoleus, Angel’s trumpet), ডম্বিয়া (Dombya mastersii), ঝুমকা জবা (Hibiscus schizopetalous, Coral hibiscus), নীল জবা (H. syriacus, Rose of sharon), স্বর্ণচামেলী (Jasminum humile, Yellow jasmine), জেট্রফা (Jatropha panduraefolia), জহুরি চাঁপা (Magnolia pumila), দাঁতরাঙ্গা/লুটকি (Melastoma malabathricum, Indian rhododendron), অঞ্জন (Memecylon umbellata, Red iron wood), নীল চিতা (Plumbago auriculata, Cape leadwort), রন্ডেলেসিয়া (Rondeletia odorata), রাসেলিয়া (Russelia juncea, Coral plant), সোনাপাতি (Tecoma gaudichandi, T. stans, Yellow bell), নীল ঘণ্টা (Thunbergia erecta)।
লতা এগুলির অধিকাংশই বহুবর্ষজীবী, কান্ড দুর্বল বিধায় নিজেই কিংবা অাঁকশি, কাঁটা ইত্যাদি উপাঙ্গের সাহায্যে আশ্রয় জড়িয়ে উপরে ওঠে। এগুলি মাটিতে তেমন জায়গা দখল করে না বলে ছোট বাগানেও বেশি সংখ্যায় লাগানো যায়। দালান, ফটক, বেড়া ইত্যাদিতে লতা বহুল ব্যবহূত। এগুলির অনেক প্রজাতি রঙিন ফুল ও অন্যগুলি সুগন্ধি প্রস্ফুটনের জন্য আকর্ষণীয়। লতানো গোলাপ ও বাগানবিলাসের এজন্য বিশেষ সমাদর। বাগানের সাধারণ লতার মধ্যে আছে: মালতী লতা (Aganosma dichotoma), হলুদ ঘণ্টাফুল/হরকাকরা (Allamanda cathartica), অনন্তলতা (Antigonon leptopus), কাঁঠালী চাঁপা (Artabotrys odoratissimus, Climbing ylangylang), বাগানবিলাস (Bougainvillea glabra, B. peruviana, B. spectabitis), ট্রাম্পেট ক্লাইম্বার (Campsis grandiflora, Trumpet climber), ব্লিডিং হার্ট (Clerodendrum thomsonae, Bleeding heart), অপরাজিতা (Clitoria ternatea, Mussel-shell climber), উলটচন্ডাল (Gloriosa superba, Glory lily), ভাদ্রা (Gmelina hystrix), মাধবীলতা (Hiptage benghalensis, চন্দ্রমুখী, দুধিয়া লতা (Ipomea abla, Moon flower), রেললতা (I. palmata, Railway creeper), মর্নিংগ্লোরি (I. Indica, Morning glory), জুঁই (Jasminum auriculatum), চামেলী J. grandifloram, Spanish jasmine), যূথিকা (J. offiinale, White jasmine), হ্যানিস্যাকল (Lonicera japonica, Japanese honeysuckle), ঝুমকা লতা (Passiflora caerulea, Passion flower), নীলমণি লতা (Petrea volubilis, Purple wreath), লতা পারুল (Psendocalyma alliaceum, Garlic vine), গোল্ডেন শাওয়ার (Pyrostegia venusta), তারামণি লতা, কুঞ্জলতা (Quamoclit pinnata, Cypress vine), মধুমালতী/মধুমঞ্জরি লতা Quisqualis indica, Rangoon creeper).
কন্দজ এগুলি সাধারণত বহুবর্ষজীবী, সচরাচর শীতে মরে যায় ও বসন্ত-গ্রীষ্মে আবার গজায়। কোন কোনটির ফুল খুবই আকর্ষণীয়, কোনটি বা সুগন্ধি। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: বেলেডনা লিলি (Amaryllis belladona), লেপার্ড লিলি (Belamcanda chinensis, Leopard flower), কলাবতী/সর্বজয়া (Canna indica), সুখদর্শন (Crinum bulbispernum, Cape lily), ইউকারিস লিলি (Eucharis amazonica), গ্লাডিওলাস (Gladiolus spp.), ফায়ারবল লিলি (Haemanthus multiflorus, Fireball lily), দোলনচাঁপা (Hedyechium coronerium), স্পাইডার লিলি (Hymenocallis littoralis, Spider lily), ভুঁইচাঁপা (Kaempferia ratunda), রজনীগন্ধা (Polianthes tuberosa, Tuberose), ঘাসফুল (Zephyranthes spp., Zephyr lily).
মৌসুমি ফুল এগুলি সাধারণত শীতের শুরুতেই চাষ করা হয়, কোন কোনটি বর্ষায়ও। শীতের বিবর্ণ প্রকৃতিতে নানা রং ছড়ায় বলে এগুলির বিশেষ সমাদর। অধিকাংশই বিদেশী। এগুলির মধ্যে আছে: অ্যাজিরাটাম (Ageratum maxicana, Floss flower), হলিহক (Althaea rosea, Hollyhock), অ্যান্টারিনাম (Antirrhinum majus, Snapdragon), ক্যালান্ডুলা (Calendula officinalis, Pot marigold), অ্যাস্টার (Callistephus chinensis, Aster), মোরগ ফুল (Celosia argentea, Cockscomb), কর্ন ফ্লাওয়ার (Centaurea cyanus, Cornflower), সুইট সুলতান (C. moschata, Sweet sultan), চন্দ্রমল্লিকা (Chrysanthemum spp), ক্যারিওপসিস (Coreopsis drummondii, Calliopsis), কসমস (Cosmos bipinnatus, Cosmos), বর্ষাতি কসমস (C. sulphureus, Summer cosmos), ডালিয়া (Dahlia variabilis, Dahlia), লার্কস্পার (Dalphinium ajacis, Larkspur), সুইট উইলিয়ম (Dianthus barbatus, Sweet willian), কার্নেসন (D. caryophyllus, Carnation), পিংক (D. chimnensis, Indian pink), গ্যালার্ডিয়া (Gaillardia pulchella, Blanket flower), সূর্যমুখী (Helianthus annuus, Sunflower), বোতাম ফুল (Gomphrena globosa, Globe amaranta), স্ট্র ফ্লাওয়ার Helichrysum bracteatum, Strawflower), দোপাটি (Impatiens balsamina, Balsam), মর্নিংগ্লোরি (Ipomea rubrocaerulea, Marning glory), সুইট পি (Lathyrus odoratus, Sweet pea), লবেলিয়া (Lobelia erinus, Lobelia), লুপিন (Lupinus spp, Lupin), পপি (Papaver rhoeas, Corn popy), পেটুনিয়া (Petunia hybrida, Petunia), ফ্লক্স (Phlox drummondii, Phlox), পর্তুলেকা (Portulaea grandiflora, Rose moss), স্যালভিয়া (Salvia coccinea, Sage), গাঁদা (Tagetes erecta, African marigold), কালী গাঁদা (T. patula, French marigold), ন্যাস্টারসিয়াম (Tropaeolum majas, Nasturtium), ভার্বেনা (Verbena hybrida, Verbena), পেন্সি (Viola tricolor hortensis, Viola), জিনিয়া (Zinnia elegans, Zinnia)।
প্রাকৃতিক নিয়মে তরুপ্রজাতি প্রতিনিয়তই স্থান বদলায়। সুদূর আফ্রিকা কিংবা লাতিন আমেরিকার কোনো গাছ আমাদের দেশে এসেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। আবার আমাদের অঞ্চলের কোনো গাছ অস্ট্রেলিয়ায় প্রাকৃতিক বৃক্ষ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। এ কারণেই গাছপালাকে নির্দিষ্ট কোনো ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ করা যায় না। সমগ্র পৃথিবী তার আবাসস্থল। তাই সবধরনের গাছপালাকেই সমগুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখতে হয়। নানাভাবে আমাদের দেশে এসে থিতু হওয়া বিদেশি গাছগুলোকে দেশি নাম দিয়ে বরণ করা উচিত। রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বিভিন্ন শ্রুতিমধুর নাম দিয়ে অনেক বিদেশি গাছপালাকে আপন করে নিয়েছেন। পেট্টিয়া’র নাম রেখেছেন নীলমণিলতা, রেঙ্গুনক্রিপারের নাম মধুমঞ্জরি লতা, মিলিংটোনিয়ার নাম হিমঝুরি, 'অ্যাডেনিয়াম' এর বাংলা নাম ‘কিন্নরী’,পাসসিফ্লরা এর নাম ঝুমকোলতা, এমন আরও কিছু গাছকে তিনি বাংলা নাম দিয়ে আদৃত করেছেন।
আরো কিছু বিদেশী গাছের নাম দিয়েছেন বিভিন্ন কবি, লেখক ও সবুজপ্রেমীরা । যেমন, আফ্রিকান টিউলিপ এর বাংলা নাম রুদ্রপলাশ,ক্রেব/ফুরুস এর বাংলা নাম ফুল্লরা,পয়েন্সেটিয়ার বাংলা নাম অগ্নিপত্রা, ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা\ উদয়পদ্ম, .স্কারলেট কর্ডিয়া\রক্ত্ররাগ, পুটুশ-ছত্রা/ল্যান্টানা,মর্নিং গ্লোরী \ভোরের-রানী, লিসিএন্থাস\ নন্দিনী, হোয়াইট বাটারফ্লাই পিএ(সাদা অপারাজিতা) মহাশ্বেতা ...
ইত্যাদি কিন্তু তারপর এক বিরাট শূন্যতা! বছরের পর বছর ধরে অনেক বিদেশি গাছ আমাদের দেশে এসে থিতু হয়েছে, অথচ তাদের কোনো বাংলা নাম নেই। ফলে শুরু হয়েছে বিভ্রান্তি। একেকজন একক নামে চেনেন। এই সুযোগে গাছ বিক্রেতারাও রাতারাতি নামের কারিগর সেজে বসেছে। ক্রেতাদের সামনে ভুল-ভাল নামে উপস্থাপন করছে বিভিন্ন বিদেশি গাছ। এসব বিদেশি গাছপালা সংখ্যায় নেহায়েৎ কম নয়।
এমন কয়েকটি বিদেশি গাছের নাম এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না;, গ্লিরিসিডিয়া, মিলেশিয়া, জ্যাকারান্ডা, কমব্রেটামলতা, অ্যালমান্ডা, ইউক্যালিপটাস, ইপিল ইপিল, ব্রনফেলসিয়া, অ্যারোকেরিয়া, ক্যাশিয়া সায়ামিয়া, ক্যাশিয়া জাভানিকা, ক্যামেলিয়া, গুস্তাভিয়া, গোল্ডেন শাওয়ার, গ্ল্যাডিওলাস, ট্যাবেবুইয়া, ট্রাম্পিট লতা, পেটুনিয়া, পেল্টোফরাম টেরোকার্পাম, বটলব্রাশ, মানিপ্ল্যান্ট, ল্যান্টানা, সাইকাস, স্কারলেট কর্ডিয়া ইত্যাদি। উদ্ভিদবিজ্ঞানী, কবি, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে নামকরণের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তাহলে বিদেশি গাছের নাম নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না।
বাগান করতে গেলে যে প্রশ্ন সবার প্রথমে মনে আসে,কখন কি গাছ লাগাবো,কখন কি ফুল ফোটে >? আমি আমার মতো করে বিভিন্ন মরশুমে ফোটা ফুলের একটি চিত্র দেবার চেস্টা করলাম ।
১. সারা বছর ফোটে এমন ফুলঃ
(ক) লতানোঃ অপরাজিতা, কাঁঠালীচাঁপা, কেশরাজ, মর্নিংগ্লোরি, মুসেন্ডা
(খ) বীরুৎঃ নয়নতারা, সন্ধ্যামালতী
(গ) গুল্মঃ কুন্দ, করবী, গোলাপ, গন্ধরাজ, জবা , ঝাঁটি, ঝুমকো জবা, টগর, ধুতুরা, নীল ঘন্টা, বেলী, মেহেদী, মল্লিকা, রঙ্গন, লঙ্কাজবা, লুটকি, শিবজটা, হাস্নাহেনা
(ঘ) বৃক্ষঃ বটলব্রাশ
২. ফেব্রুয়ারী থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) লতানোঃ নীলমণিলতা, মাধুরীলতা
(খ) বীরুৎঃ কলাবতী
(গ) গুল্মঃ ক্যামেলিয়া, গোকুল
(ঘ) বৃক্ষঃ অশোক, কাঠবাদাম, পারিজাত, পারুল, পিয়াল, পলাশ, বকুল, মুচকুন্দ, শিমুল
৩. এপ্রিল থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) লতানোঃ গন্ধভাদালী, চামেলী, ঝুমকো, লবঙ্গলতা
(খ) বীরুৎঃ দোপাটি, ভূঁইচাঁপা, লিলি, কালো বাসক
(গ) গুল্মঃ কাঁটা মেহেদী, ডালিম, সুরভী
(ঘ) বৃক্ষঃ উদয়পদ্ম, ক্যাসিয়া, কনকচাঁপা, কলকে, কৃষ্ণচূড়া, গাব, গামারী, গুলাল, ঘোড়া নীম, জারুল, তেলশুর, নীম, পাদাউক, পেল্টোফোরাম, বরুণ, শিরীষ, সোনালু, লাল সোনাইল
৪. জুন থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) লতানোঃ উলটচণ্ডাল, কুঞ্জলতা, জুঁই, মাধবীলতা
(খ) বীরুৎঃ দোলনচাঁপা, দুপুরচণ্ডী, রজনীগন্ধা
(গ) গুল্মঃ কাঞ্চন, কেয়া, ঘেঁটু, নীলজবা, ফুরুস, রাধাচূড়া, লান্টানা, শ্বেত অতসী
(ঘ) বৃক্ষঃ কামিনী, কদম, চাঁপা, নাগেশ্বর, নাগলিঙ্গম
৫. অগাস্ট থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) বীরুৎঃ মোরগ ফুল
(খ) গুল্মঃ ঘন্টাফুল, স্থলপদ্ম
(গ) বৃক্ষঃ শিউলি
৬. অক্টোবর থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) বীরুৎঃ অতসী
(খ) বৃক্ষঃ কাঞ্চন, ছাতিম, হিজল
৭. ডিসেম্বর থেকে ফোটা শুরু হয় এমন ফুলঃ
(ক) লতানোঃ অনন্তলতা, বাগানবিলাস
(খ) বীরুৎঃ গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, অ্যাস্টার, কসমস, জিনিয়া, ডালিয়া, পিটুনিয়া, পর্টুলেকা, ফ্লক্‌স, ভার্বেনা, লার্কস্পার, সুইট পি, সালভিয়া, হলিহক
(গ) গুল্মঃ বকফুল
(ঘ) বৃক্ষঃ কুড়চি
গত কয়েক বছর ধরেই চলছে উন্নয়নের নামে বৃক্ষ নিধন উৎসব , ছায়া সুনিবিড় নির্জন রাস্তা বদলে যাচ্ছে ঝাঁ চকচকে হাই ওয়ে তে । আজকের কেরিয়ারিস্ট ছেলেমেয়েদের কাছে গাছ ফুল নিয়ে এই সব আলোচনা , কিছু নিস্কর্মা বোকা,হাফ পাগল লোকের কাজ ।
কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখি জানেন,এই ঝাঁ চকচকে রাস্তার দুই ধার বর্ণে গন্ধে উজ্জ্বল হয়ে আছে, পলাশ,কুরচি,জাকারান্ডা,লাল সোনাইল,কনকচুড়া,শিমুল,রাধাচুড়া, স্বর্ণচাঁপা ,অশোক, গুলমোহর ,হিজল প্রভৃতি গাছে ।
আপনি একবার কল্পনায় ভেবে দেখুন। আপনার চোখের সামনে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পথ। তার দু’পাশে থরে থরে সাজানো জারুল, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়া। বিন্যাসটা এমন যে প্রথমে কৃষ্ণচূড়া, তারপর সোনালু, সোনালুর পর জারুল; এভাবেই তৈরি করা হয়েছে তিন রঙের সুসজ্জিত বীথি। জারুলের রঙ উজ্জ্বল বেগুনি, সোনালুর রঙ হলুদ, সোনালি আর কৃষ্ণচূড়ার প্রধান রঙ টকটকে লাল। এমন সৌন্দর্য থেকে কি চোখ ফেরানো যায়? চোখটা সরিয়ে নিলেও মনটা কিন্তু পড়েই থাকবে সেখানে। আর সেখানেই যদি হয় আমাদের পুষ্প উৎসব, তাহলে কেমন হয়। আমরা এমন একটি পুষ্প উৎসবের স্বপ্ন দেখছি দীর্ঘদিন। এমন একটি স্বপ্ন দেখা কি অবান্তর কারণ গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে ছড়ানো থাকে যাবতীয় উন্মাদনার রঙ। কৃষ্ণচূড়ার রঙ পাগল করা। অনেকদূর থেকেই তার উজ্জ্বল রঙ আমাদের উতলা করে। জাপানে শুধু চেরি ফুল ফোটার মৌসুমে ওরা প্রতিবছর মস্তবড় উৎসব করে। ওদের একটিই তো ফুল; আর আমাদের আমাদের বৃক্ষবৈচিত্র্য : নতুন ভাবনা
তিন তিনটি প্রধান ফুল। তাহলে কেন আমরা বঞ্চিত হচ্ছি এমন একটি নান্দনিক উৎসব থেকে। আমাদের দেশে এই ধরনের একটি অ্যাভিনিউ তৈরি করা কি খুব ব্যয়বহুল? মোটেই না, অতি সহজ। আমাদের অনেক সড়ক আছে, যার দু’পাশ এখনো বৃক্ষ ও ছায়াহীন। এমন একটি সড়কই বেছে নিতে পারি। হতে পারে কলকাতার অদূরে কিংবা অনেক দূরে। আবার নতুন কোনো সড়কও হতে পারে। পর্যায়ক্রমে রেল সড়কের পাশেও এমন বর্ণচ্ছটা তৈরি করা যেতে পারে। এমন একটি পুষ্প বিন্যস্ত পথকে ঘিরে প্রাথমিক পর্যায়ে উৎসবটি হতে পারে দু’দিনব্যাপী।
আমি ১০০% আশাবাদী একদিন আমাদের এই বাংলার প্রতিটা রাস্তা,রেল সড়কের দুই ধার সেজে উঠবে ফুলে,ফলে , হয়ত সেদিন আমি থাকব না ,তবু ,.........
" আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।
হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে।
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।"
গ্রন্থঋন --
Green Nature, Each Flower Is A Word, - Dwijen Sharma

বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৭

উদ্ভিদ জগতের বকচ্ছপ বা কিমেরা (ভেরিগেটেড গাছ) ঃ-


.
ইদানিং বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি ভেরিগেটেড গাছের খুব চাহিদা।এই ভেরিগেটেড সম্পর্কে আলোচনার জন্যই এ প্রবন্ধের অবতারনা।
ছেলেবেলায় শুনেছি অগ্নি উদ্গীরণকারী প্রাণী কিমেরা-র গল্প। গ্রীক পুরাণের এক দানব প্রানী এই কিমেরা যার মুখ সিংহের, দেহ ছাগলের আর লেজ সাপের মতো।
ছেলেবেলায় সুকমার রায় এর 'আবোল তাবোল' হাতে পেতেই পড়ে ফেললাম বকচ্ছপ,হাতিমি ও অন্যান্য অদ্ভুত প্রাণিদের কথা।
ট্যাঁশ্ গরু গরু নয়, আসলেতে পাখি সে;
যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে।
চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু, মুখখান মস্ত,
ফিট্‌ফাট্ কালোচুলে টেরিকাটা চোস্ত।
তিন-বাঁকা শিং তার ল্যাজখানি প্যাঁচান-
একটুকু ছোঁও যদি, বাপরে কি চ্যাঁচান!
লট্খটে হাড়গোড় খট্‌খট্ ন'ড়ে যায়,
ধম্‌কালে ল্যাগ্‌ব্যাগ চমকিয়ে প'ড়ে যায়।
বর্ণিতে রূপ গুণ সাধ্য কি কবিতার,
চেহারার কি বাহার- ঐ দেখ ছবি তার।
ট্যাঁশ্ গরু খাবি খায় ঠ্যাস্ দিয়ে দেয়ালে,
মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে ;
মাঝে মাঝে তেড়ে ওঠে, মাঝে মাঝে রেগে যায়,
মাঝে মাঝে কুপোকাৎ দাঁতে দাঁত লেগে যায়।
খায় না সে দানাপানি- ঘাস পাতা বিচালি
খায় না সে ছোলা ছাতু ময়দা কি পিঠালি;
রুচি নাই আমিষেতে, রুচি নাই পায়েসে
সাবানের সুপ আর মোমবাতি খায় সে।
আর কিছু খেলে তার কাশি ওঠে খক্‌খক্,
সারা গায়ে ঘিন্ ঘিন্ ঠ্যাং কাঁপে ঠক্‌ঠক্।
একদিন খেয়েছিল ন্যাকড়ার ফালি সে-
তিন মাস আধমরা শুয়েছিল বালিশে।
কারো যদি শখ্ থাকে ট্যাঁশ গরু কিনতে ,
সস্তায় দিতে পারি,দেখ ভেবে চিন্তে।'
মনে আছে ,এই ছড়া পরেই বাবার কাছে বায়না ধরেছিলাম,ট্যাঁস গরু কিনে দেবার জন্য । 'হারু কাকু' আপিস নিশ্চয়ই বাবার আপিসের কাছাকাছি ই হবে , অন্তত সেখানে গিয়ে ট্যাঁস গরুটা দেখে আসার খুব ই ইচ্ছে ছিল ।😀😁😁
আজ এই প্রবন্ধ লিখতে বসে একা একাই হাসছি সেদিনের কথা ভেবে ।
এই গল্পের আসল উদ্দেশ্য হল, উদ্ভিদ জগতের সাথে এই কিমেরার এক সাদৃশ্য তৈরি করা। একটি কিমেরা-প্রাণি যেমন কয়েকটি ভিন্ন প্রাণির দেহের সমন্বয়ে তৈরি, একটি কিমেরা-গাছও তেমনি দুই বা ততোধিক ভিন্ন টিস্যু দিয়ে গঠিত। যে কারণে আমরা দেখতে পাই একই প্রজাতির গাছের পাতায় নিরেট সবুজের পরিবর্তে এক ভিন্ন রূপ, যাতে দেখা যায় শাদা-হলুদ আর সবুজের অদ্ভুত মিশ্রণ।
বাগান ছাড়াও শহুরে রাস্তার আয়ল্যান্ডে আমাদের চোখে পড়ে এ ধরনের কিমেরা গাছ বিশেষ করে বেনজামিনা বট আর টগর। এদের আমরা সাধারণভাবে ইংরাজিতে বলি ভেরিয়েগেটেড প্ল্যান্ট (Variegated Plant) আর বাংলায় বলি বিচিত্র গাছ যেমন, বিচিত্র বকুল। প্রকৃত প্রস্তাবে এগুলো কিমেরা গাছ। এদের অধিকাংশেরই কিনারা থাকে শাদা আর ভেতরটা সবুজ। কিন্তু কখনো এমন কিছু পাতাও দেখা যায় যা ঠিক এর উলটো, কিনারা সবুজ আর ভেতরটা শাদা। মজার ব্যাপার হল, একই প্রজাতির একটি গাছে এমন দু-ধরনের পত্র-বৈচিত্রই দেখতে পাওয়া যায়, শাদার ভেতরে সবুজ এবং সবুজের ভেতরে শাদা। এর নাম জাপানি টাকু। এক সময় এই ক্ষুদ্র গাছের কাণ্ড থেকে তৈরি হত উল জড়ানো টাকু যে কারণে এই নাম। নিচে জাপানি টাকু-র বিচিত্র প্রজাতির দুটি ছবি দেয়া গেল।
একটি শাদা-সবুজ বিচিত্র পাতার নক্সা কেমন হবে তা নির্ভর করে কোথায় কোন অঞ্চল থেকে এর মিউটেশান হয়েছে বা সহজ ভাষায় বলা যায়, কোষ-রূপান্তর ঘটেছে। গাছের ওপরের দিকের বৃদ্ধি হয় গাছের ডগায় যেখানে থাকে ভাজক-কলা, যা খুব দ্রুত কোষ বিভাজন করে গাছকে বড় করে তোলে। এসব ভাজক-কলার বাইরের স্তরের কোষগুলি পাতার উপরিভাগ আর কিনারা নির্মানের জন্যে দায়ী, আর ভেতরের দিকের কোষ পাতার বাকি অংশের জন্যে। যদি বাইরের কোষে মিউটেশান হয় তাহলে কিনারা হবে ক্লোরোফিলশূন্য শাদা, আর ভেতরটা হবে সবুজ, ক্লোরোফিলময়। আর ভেতরের কোষে রূপান্তর হলে কিনারা হবে সবুজ, আর ভেতরটা শাদা। এই বৈচিত্র যে কেবল পাতায় থাকতে পারে তা নয়, কাণ্ডেও দেখা যেতে পারে এর প্রভাব, যেমন বিচিত্র ইক্ষু। কালে কস্মিনে ফলে বা হঠাৎ বীজেও দেখা যেতে পারে এই বিচিত্রতা।
কিন্তু কিমেরাসম্ভূত শুধু শাদা বা হলুদ রঙের জন্যে পত্র-বৈচিত্র নয়, বিস্তৃত চিন্তায় আরো কিছু কারণেও বৈচিত্র দেখা দিতে পারে গাছে। এলুমিনাম প্ল্যান্টের পাতার ওপরে একটু ফুলো দেখা যায়। এর কারণ সবুজ ক্লোরোফিল-এর ওপরে একটি স্বচ্ছ স্তর থাকে যার ভেতরে থাকে বায়ুস্তর। এই বাইরের স্তরের ওপর সূর্যের আলো পড়লে তা প্রতিফলিত আর প্রতিসরিত হয়ে রূপালি রঙ ধারণ করে। পাতায় রূপালি রঙ তৈরি হবার জন্যে অবশ্য আরো কারণ থাকতে পারে যেমন, ইন্ডোর পান্ডা প্ল্যান্টের পাতায় সূক্ষ্ম এবং স্বচ্ছ রোম থাকে যার ওপর রোদের আলো পড়লে রূপালি রঙ ঝিকমিক করে ওঠে। কলেরেডো স্প্রুস-এর পাতা রূপালি দেখায় কারণ সূঁচের মতো সরু পাতার গায়ে মোম জড়ানো থাকে এদের। তবে যে কারণেই পাতাকে রূপালি দেখাক না কেন, গাছের পাতার ভেতরে এমনিতে কিন্তু কোনো রূপালি রঙ মজুদ থাকে না। পাতায় অন্যান্য যে সব রঙ থাকে তার ভেতরে আছে এন্থোসায়ানিন, ক্যারোটিনয়েড, জ্যান্থোফিল ইত্যাদি। এক ধরণের খলিফা গাছ বা Acalypha-র শাদা অংশের ওপরে লাল-গোলাপি এন্থোসায়ানিন রঙ বিস্তৃত হয়ে পড়লে শাদা অংশ গোলাপি দেখায় আর সবুজ অংশ দেখা যায় মেরুন রঙের। রঙিন বৈচিত্রের একটি সুন্দর উদাহরণ হল বেগোনিয়া যার রোমশ হুল থেকে বিচিত্র রঙ দেখা দেয়।
গাছের শাদা অংশের ওপর হলুদ জ্যান্থোফিল রঙ থাকে এক ধরনের প্রতিরক্ষার জন্যে কারণ শাদা অঙ্গ সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির কারণে নষ্ট হতে পারে। জ্যান্থোফিল কোষে কিছুটা আলোকরশ্মি শোষিত হয় বলে সালোকসংশ্লেষণ হয়। আউটডোরে যেসব ভেরিয়েগেটা গাছ দেখা যায়, যেমন বিচিত্র মন্দিরা তাদের শিরা-উপশিরার শাদা অংশের জায়গায় হলুদ রঙ দেখা যায়। উদ্ভিদের সামগ্রিক রঙ-বৈচিত্রের কথা ভাবলে বিচিত্র উদ্ভিদজগতকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, এলবিনো বৈচিত্র এবং রঙিন বৈচিত্র। মূলত সবুজকণাশূন্য এলবিনোর সঙ্গেই সম্পর্ক আলোচিত কিমেরা গাছের, রঙিনের সঙ্গে নয়।
একটি অদ্ভুত ব্যাপার হল, রোগের কারণেও কিন্তু অনেক সময় গাছে ভেরিয়েগেশন দেখা দিতে পারে। এতে অনেক ক্ষেত্রে গাছের কোনো ক্ষতিও তেমন চোখে পড়ে না। ১৭ দশ শতকে টিউলিপ-এর একটি প্রজাতির জন্যে লোকজন পাগল ছিল যা মূলত ছিল একপ্রকার মোজেইক ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত গাছ। ঢাকার রাস্তায় আয়ল্যান্ডে আমি কিছু টগর গাছ দেখেছি যা সুস্থ টগরের মতো নয় কিন্তু সহজে বোঝার উপায় নেই সেগুলি রোগগ্রস্ত। ইসরাইলে টগর গাছে এক ধরনের টোবামোভাইরাস দেখা দিয়েছিলো এক যুগ আগে। ভয় হয় সেই রোগ আবার ছড়িয়ে পড়ছে না কি আমাদের টগরে, সিলেটে যার আদুরে নাম দুধফুল। আমাদের দেশের শিমের পাতাও এমন ‘বিন ইয়েলো মোজেইক ভাইরাস’-এ আক্রান্ত হয় কখনো যার বিস্তার ঘটে এফিডের মাধ্যমে। এতে পাতার অঞ্চল এমন সমানভাবে ভেরিয়েগেটা হয় যে মনে হয় ভিন্ন কোনো প্রজাতি বা উপপ্রজাতির গাছ। আমরা আর কি বলবো, এই ভুল করেছেন আমেরিকার খ্যাতনামা ট্যাক্সোনমিস্টরাও, তারাও মোজেইক ভাইরাসে আক্রান্ত গাছকে ভেবেছেন নতুন কোনো কাল্টিভার বা আবাদ করা শস্য।
যে সব গাছের পাতা বিচিত্র হয়, মূলত শাদা এলবিনো অংশের কারণে, সেসব গাছ স্বভাবতই কিছুটা দুর্বল হয়, কারণ শাদা অংশে ক্লোরোফিলের অভাবে খাদ্য উৎপন্ন হয় না। পুষ্টির অভাবে এসব গাছ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং গাছে ফুলও ধরে কম। এ ধরনের গাছ বেশিরভাগ দেখা যায় ইনডোরে যেখানে আউটডোরের তীব্র সূর্যালোকে শাদা অংশ জ্বলে যাবার সম্ভাবনা থাকে না। মূলত সারা পৃথিবীতে ইন্ডোরের অধিকাংশ গাছ এসেছে আমাজনের বর্ষাবন থেকে। বড় বড় কাছের ক্যানপিতে ঢাকা থাকে বলে এই বনের মেঝেতে গুল্ম বা ক্ষূপ জাতীয় গাছের ভাগ্যে আলোক জোটে খুবই কম। তাই উত্তরাধিকার সূত্রেই স্বল্পালোকে অভ্যস্ত এসব গাছ ইনডোরেই ভাল থাকে বেশি। কখনো কখনো দেখা যায় টবে বা মাটিতে ধবধবে শাদা এলবিনো চারা গজায়, কিন্তু ক্লোরোফিল না থাকার কারণে শেকড়ের মজুদ খাবার শেষ হলেই এই গাছ মরে যায়। তবে একটা ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম বেশ চাক্ষুষ। ক্যালিফোর্নিয়ার রেডউড-এর জঙ্গলে বেশ কিছু বিশাল আকারের শাদা এলবিনো গাছ দেখা যায়, যার ভেতর ক্লোরোফিলের লেশমাত্র নেই। অথচ সবুজ বনানীতে বরফের মতো শাদা এই পরমাশ্চর্য মহীরুহ বেঁচে থাকে শতবর্ষব্যাপী। এরা খাদ্য সংগ্রহ করে অন্য গাছের শেকড় থেকে যারা মাটিতে প্রোথিত একই শেকড় থেকে জন্মানো সহোদর।
কিমেরা বৈচিত্রের গাছ যেমন ফাইকাস বেনজামিনা রূপ বদলাতে পারে কিন্তু কাঠামোগত বিচিত্র গাছগুলি তা পারে না যেমন, এলুমিনাম প্ল্যান্ট। সূর্যের আলো বেশি হলে এরা অধিক বিচিত্র হয়ে যেতে পারে আর কম হলে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্যে শাদা থেকে ধীরে ধীরে সবুজও হয়ে যেতে পারে। শুধু আলোক নয়, যারা শখের বাগান করেন বা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে নার্সারি করেন তাদের এ ধরনের আরো কিছু বিষয় জানা থাকলে ভেরিয়েগেটা উদ্ভিদের চারা তৈরি এবং লালনপালনে কিছু সহায়তা হতে পারে।

যেহেতু কিমেরা উদ্ভিদে দুই ধরনের টিস্যু থাকতে হয়, এলবিনো ও সবুজ, তাই বীজ বা শেকড় থেকে চারা তৈরি করলে তা বিচিত্র স্বভাবটা পায় না। শেকড় ও বীজ থেকে মাত্র এক প্রকারের টিস্যু উৎপন্ন হয়, রূপান্তরিত টিস্যু ব্যতিরেকে, তাই গাছের পাতা সবুজ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। অতএব এ ক্ষেত্রে ভেজিটেটিভ প্রোপাগেশান বা ভেষজ বিস্তারণ-ই ভাল। বিচিত্র অংশের কাণ্ড এবং কক্ষমুকুলেও পাওয়া যায় দু’ধরণের টিস্যু।

হলুদ ব্যান্ডের স্যানসেভিয়েরা বা স্নেক প্ল্যান্টের পাতার গোড়ার দিকে চারা গজায়, ঠিক মাঝখান থেকে যা থাকে ব্যান্ডের সবুজ অংশে। তাই সেখান থেকে চারা নিয়ে বড় করলে তাতে হলুদ ব্যান্ড হবার সম্ভাবনা নেই, চারা করতে হবে রানার (Runner) বা সাকার (Sucker) থেকে।

নাইট্রোজেন সারের পরিমাণ শূন্য করে অথবা খুব কমিয়ে ফেলতে হবে, কারণ এর জন্যে ক্লোরোফিলগুলি সংখ্যায় বাড়তে থাকে এবং পুষ্ট হয়। নাইট্রোজেন সার ব্যাক্টেরিয়ার কারণে গাছের ব্যবহার উপযোগী হয় এবং মাটির একটা বিশেষ pH ভ্যালুতে এই ব্যাক্টেরিয়া বেশি কার্যকর হয়। অতএব সুবিধা থাকলে pH বা অম্লাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ভালো হয়।

বিচিত্র গাছের যে অংশের পাতা পরিপূর্ণ এলবিনো হয়ে গেছে সেখান থেকে বা যেখানে পরিপূর্ণ সবুজ সেখান থেকে চারা করার জন্যে স্টেম কাটিং সংগ্রহ করলে ভেরিয়েগেটা হবার সম্ভাবনা বিরল হবে। বুগেনভিলিয়ার ক্ষেত্রে সম্মীলিত শাদা-লাল কাণ্ডের কাটিং নিতে হবে। বিচিত্র গাছের কোনো অংশে সবুজায়ন শুরু হলে সেই অংশ কেটে ফেলা ভাল, তাতে গাছের সবুজ হবার প্রবণতা বন্ধ করা যাবে।
প্রবন্ধ উপযোগী কিছু বিচিত্র গাছের নাম...
Ficus benjamina starlight, Ficus benjamina microcarpas, Euonymus japonica, Tabernaemontana divaricata, Hedera helix- English Ivy, Agave americana, Syngonium podoophyllum, Codaeum variegatum, Pilea cadierei, Colocasia esculenta, Erythrina variegata, Acalypha wilkesiana, Alocasia amazonica, Sansevieria trifascata
ছবিগুলি আমাদের ওঙ্কার ধামের ভেরিগেটেড গাছের --
স্নেক প্ল্যান্ট- Sansevieria trifascata হলুদ ব্যান্ড, মাঝখানে সবুজ 

তথ্য সহায়তা: মান্যবুরেশু ভাত্রিপ্রতিম অধ্যাপক অনির্বাণ মিত্র ও জায়েদ ফরিদ।


মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৭

'দারুণ আলাদা একা অভিমানী এই ক্যাকটাস
 যেন কোন বোবা রমণীর সখী ছিলো দীর্ঘকাল
 কিংবা আজন্ম শুধু দেখেছে আকাল
 এরকম ভাব-ভঙ্গি তার।
 ধ্রুপদী আঙিনা ব্যাপী কন্টকিত হাহাকার আর অবহেলা,
 যেন সে উদ্ভিদ নয়
 তাকালেই মনে হয় বিরান কারবালা।'
                            ------- হেলাল হাফিজ 

ক্যাকটাস সত্যি অন্য রকম। আর সব গাছের মতো, ফুলের মতো নয়। সাদা চোখে প্রাণহীন দেখায় বটে। বাস্তবে এর ভরপুর প্রাণ। বহু বছর বাঁচে। সৌন্দর্য বিলি করে। এভাবে বছরের পর বছর বাসার বারান্দা বা ছাদের টবে টিকে থাকে। ড্রইংরুমেও নির্ঝঞ্ঝাট ক্যাকটাস। সব মিলিয়ে সৌন্দর্যপ্রেমীদের ভীষণ প্রিয়।
   খুবসহজে চোখে পড়ে এর সৌন্দর্যটা। অবশ্য ক্যাকটাসের বেলায় খুব যে যত্নের  দরকার হয়, তাও নয়। বিশেষ পরিচর্যা  ছাড়াই দিব্যি বেঁচে থাকে। আলো-বাতাস-পানির তেমন দরকার হয় না। বৃদ্ধির জন্য জায়গায়ও লাগে কম। কাঁটা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। নিন্দুকেরা বলেন, ক্যাকটাস খুব স্বার্থপর! সহজে কারও উপকারে আসে না। গায়ে কোন পোকার মাকড় বসবে? খাদ্য খুঁজবে? না, সে সুযোগ দেয় না ক্যাকটাস। এর গায়ের ঘন কাঁটা তাদের রুখে দেয়। ক্যাকটাস শেকড় দিয়ে আশপাশের সব গাছের পানি নাকি একলা শুষে নেয়, আছে এমন অভিযোগও! এর ফলে ক্যাকটাসের পাশে অন্য কোন গাছ নাকি স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে উঠতে পারে না। তবে ক্যাকটাসের সৌন্দর্য এসব সমালোচনাকে পেছনে ফেলে দেয়। বিশেষ করে যখন ফুল ফোটে তখন অন্য রকম মুগ্ধতা নিয়ে তাকাতে হয় ক্যাকটাসের দিকে। তবে খুব স্থায়ী হয় না ক্যাকটাসের ফুল। অধিকাংশই দু’এক দিনের মধ্যে ঝরে পড়ে। তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, কোন কোন গাছ বেঁচে থাকে তিন শ’ বছর পর্যন্ত! মূলত রাতে ফুল ফোটে। ফুলের রং সাধারণত সাদা। বাহারি ফুল ফোটে দিনের বেলায়। হলুদ, লাল, গোলাপি, বেগুনি আরো কত কত রং!
  বনসাইয়ের মতো ক্যাকটাস নিয়ন্ত্রণ করে বা প্রুনিং করে বছরের পর বছর ঘরের ভেতর রাখা যায়।
                            

তুলসী একটি চমকপ্রদ গাছ

তুলসী পাতার চমকপ্রদ কিছু গুণ

1. মানসিক চাপে অ্যান্টিস্ট্রেস এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক অবসাদ প্রশমনে এমনকি প্রতিরোধে তুলসী চমৎকার কাজ করে। কোনো সুস্থ ব্যক্তি যদি প্রতিদিন অন্তত ১২টি তুলসীপাতা দিনে দু’বার নিয়মিত চিবাতে পারেন তাহলে সেই ব্যক্তি কখনো মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হবেন না বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। কর্টিসলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে মানসিক চাপ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে তুলসি পাতা। স্নায়ু শিথিল করে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, যা মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী ফ্রি রেডিকলকে নিয়ন্ত্রণ করে। অতিরিক্ত অবসাদ এবং মানসিক চাপ অনুভূত হলে ১০ থেকে ১২টি তুলসী পাতা চিবিয়ে খেয়ে নিন, উপকৃত হবেন।তুলসীর স্ট্রেস কমানোর ক্ষমতা আছে। সুস্থ মানুষও প্রতিদিন ১২ টি তুলসী পাতা চিবালে স্ট্রেস মুক্ত থাকতে পারবেন।

2. রক্তের ইউরিক এসিড-এর লেভেলকে কমতে সাহায্য করে কিডনিকে পরিষ্কার করে তুলসী পাতা। তুলসীর অ্যাসেটিক এসিড এবং  এসেনশিয়াল অয়েল এর উপাদান গুলো কিডনির পাথর ভাঙতে সাহায্য করে ও ব্যাথা কমায়। কিডনির পাথর দূর করার জন্য প্রতিদিন তুলসী পাতার রসের সাথে মধু মিশিয়ে খেতে হবে। এভাবে নিয়মিত ৬ মাস খেলে কিডনি পাথর দূর হবে।

3. চর্মরোগে তুলসী পাতা দূর্বাঘাসের ডগার সংগে বেটে মাখলে ভালো হয়ে যায়।

4. উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমিয়ে হূৎপিণ্ডের রক্ত সরবরাহের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে। লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।

5. অজীর্ণজনিত পেট ব্যথায় তুলসী পাতার বেশ উপকার সাধন করে থাকে। এটি হজমকারক। প্রতিদিন সকালে ১৮০ গ্রাম পরিমান তুলসী পাতার রস খেলে পুরাতন জ্বর, রক্তক্ষয়, আমাশয়, রক্ত অর্শ এবং অজীর্ণ রোগ সেরে যায়।

6. হাড়ের গাঁথুনিতে ব্যথা দূর করে এবং শরীরের কাটাছেঁড়া দ্রুত শুকাতে অবদান রাখে।

7. ঠাণ্ডা মরসুমে ছোট বাচ্চাদের তুলসির পাতা খাওয়ালে কৃমি দূর হবে এবং মাংসপেশি ও হাড় হবে শক্তিশালী।

8. জ্বর হলে পানির মধ্যে তুলসী পাতা, গোল মরিচ এবং মিশ্রী মিশিয়ে ভাল করে সেদ্ধ করে নিন ৷ অথবা উপরিউক্ত তিনটে দ্রব্য মিশিয়ে বড়ি তৈরি করুন ৷ দিনের মধ্যে তিন-চার বার ঐ বড়িটা পানি দিয়ে সেবন করুণ । জ্বর খুব তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।

9. কাশি হলে তুলসী পাতা এবং আদা একসাথে পিষে মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খান ৷ এতে উপকার পাবেন ৷

10. ডাইরিয়া হলে ১০ থেকে বারোটি পাতা পিষে রস খেয়ে ফেলুন।

11. মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে দিনে ৪-৫ বার তুলসী পাতা চেবান ।

12. আপনার শরীরে যদি কোনরকম ঘা যদি থাকে তাহলে তাহলে তুলসী পাতা এবং ফিটকিরি একসঙ্গে পিষে ঘা এর স্থানে লাগান।

13. শরীরের কোন অংশ যদি পুড়ে যায় তাহলে তুলসীর রস এবং নারকেলের তেল ফেটিয়ে লাগান, এতে জ্বালাপোড়া কমে যাবে। পোড়া জায়গাটা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে এবং পোড়া দাগ ওঠে যাবে।

14. ত্বকের রোশনি বাড়ানোর জন্য, ত্বকের বলীরেখা এবং ব্রোন দূর করার জন্য তুলসী পাতা পিষে মুখে লাগান।

15. প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া দূর করতে হলে তুলসী পাতার রস ২৫০ গ্রাম দুধ এবং ১৫০ গ্রাম জলের মধ্যে মিশিয়ে পান করুন । তুলসি গাছের বীজও যথেষ্ট উপকারী। এর বীজ শুকিয়ে মিহি করে খেলে প্রস্রাবের ইনফেকশনজনিত সমস্যা ভালো হয়। পুরুষত্বহীনতা দূরীকরণে এই পাতার অবদান অপরিহার্য।

16. যদি কখনও বমি কিংবা মাথা ঘোরা শুরু করে, তাহলে তুলসী রসের মধ্যে গোলমরিচ মিশিয়ে খেলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।

17. সকালবেলা খালি পেটে তুলসী পাতা চিবিয়ে রস পান করলে খাবার রুচী বাড়ে।

18. নিয়মিত তুলসীর রস পানে হৃদরোগেও উপকার পাওয়া যায়।

19. চোখের সমস্যা দূর করতে রাতে কয়েকটি তুলসী পাতা পানিতে ভিজিয়ে রেখে ওই পানি দিয়ে সকালে চোখ ধুয়ে ফেলুন।

20. তুলসীতে Eugenol অধিক পরিমাণে থাকায় তা Cox-2 Inhibitor রূপে কাজ করে বলে তা ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

21. Hypoglycemic drugs এর সাথে তুলসী খেলে তা টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয়।

22. তেজস্ক্রিয়তার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ কোষসমুহকে মেরামত করে।

23. চর্বিজনিত হৃদরোগে এন্টি অক্সিডেন্টের ভুমিকা পালন করে।

24. তুলসী একশেরও বেশি Phytochemicals (যেমন oleanolic acid, beta caryophyllene ইত্যাদি)বহন করে বলে ক্যান্সার চিকিত্সারয় ব্যবহৃত হয়।

25. তুলসীর অ্যালকোহলিক নির্যাস Immune system এর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।

26. তুলসী স্নায়ুটনিক ও স্মৃতিবর্ধক।

27. শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্নরোগ যেমন ব্রঙ্কাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাঁপানি প্রভৃতি রোগের নিরাময়ক।

28. সর্দি, কাশি, জ্বর, বমি, ডায়ারিয়া, কলেরা, কিডনির পাথর, মুখের আলসারসহ চোখের বিভিন্ন রোগে ইহা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

29. পেট খারাপ হলে তুলসীর ১০ টা পাতা সামান্য জিরের সঙ্গে পিষে ৩-৪ বার খান ৷ পায়খানা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে!

30. তুলসী মূল শুক্র গাঢ় কারক। তুলসী পাতার ক্বাথ, এলাচ গুঁড়া এবং এক তোলা পরিমাণ মিছরী পান করলে ধাতুপুষ্টি সাধিত হয় যতদিন সম্ভব খাওয়া যায়। এটি অত্যন্ত ইন্দ্রিয় উত্তেজক। প্রতিদিন এক ইঞ্চি পরিমাণ তুলসী গাছের শিকড় পানের সাথে খেলে যৌনদূর্বলতা রোগ সেরে যায়।

31. চর্মরোগে তুলসী পাতা দূর্বাঘাসের ডগার সংগে বেটে মাখলে ভালো হয়ে যায়।

সোমবার, ৫ জুন, ২০১৭

আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিবছর ৫ জুন এই দিবস পালন করা হয়। কিন্তু, দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বড়ই বেমানান প্রকৃতির ছবি। এই দিনটিতেই জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ কনফারেন্স (United Nations Conference on the Human Environment) শুরু হয়েছিল। এই কনফারেন্স হয়েছিল ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৫ থেকে ১৬ জুন অবধি। এই কনফারেন্স ঐ বছরই চালু করেছিল জাতিসংঘের সাধারণ সভা। তখন থেকেই প্রতি বৎসর এই দিবস পালিত হয়ে আসছে দিবসটি প্রথম পালিত হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। প্রতি বছরই দিবসটি আলাদা আলাদা শহরে, আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে পালিত হয়। উত্তর গোলার্ধে দিবসটি বসন্তে, আর দক্ষিণ গোলার্ধে দিবসটি শরতে পালিত হয়।
 গাছগাছালি মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শুধু মানুষই নয়, গাছপালা ছাড়া কোনো প্রাণীই জীবন ধারণ করতে পারবে না। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বেড়ে পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধানত দায়ী বৃক্ষহীনতা। দিন দিন কমে যাচ্ছে গাছের সংখ্যা। গাছপালার স্বল্পতার কারণে ভূপৃষ্ঠে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ভয়াবহভাবে বেড়ে যাচ্ছে। গাছগাছালির উপকারের কোনো শেষ নেই। একটি গাছ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে।

মানুষেরই কিছু অবিমৃশ্যকারী কাজের ফল জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বের উপর যার প্রভাব মারাত্মক৷ অবশ্য আজ মানুষ ধীরে ধীরে তার কাজের পরিণাম উপলব্ধি করতে পারছে, তাই পরিবেশ সুরক্ষায় সুচেতনার জাগরণও ঘটছে৷ শিশুদের মধ্যেও যে পরিবেশ সংরক্ষণের চেতনা জাগছে৷
কিন্তু মুশকিল হলো, এই শিশুরাই আমাদের মতো বড়দের কাজকর্ম দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে৷  মাটিতে মিশে না যাওয়া ( নন বায়ো ডিগ্রেডেবল) আবর্জনা পরিবেশের ভীষণ ক্ষতি করে৷ একথা আমরা বাচ্চাদেরও শেখাই৷ কিন্তু তারপরই আমাদের বাচ্চারা দেখে, আমরা পলিথিন প্যাকেটে করে বাজার থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসছি, আর সেই পলিথিন যত্রতত্র ফেলে দিচ্ছি৷ এ থেকে শিশুরা শিখছে, ‘এমন অনেক বিষয় আছে, যেগুলি সম্বন্ধে যা শেখানো হয়, তার উল্টোটাই করতে হয়'৷ সমুদ্রসৈকত হোক বা পাহাড়, আমরা পিকনিক করতে যাই, আর বিভিন্ন ক্ষতিকর আবর্জনা আমরা সেখানে ফেলে আসি৷ এমনকি আজ হিমালয়ের উচ্চতম স্থানগুলিও রেহাই পাচ্ছে না৷ একটা ব্যক্তিগত কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার কথা বলি৷ আমার বাচ্চাকে শিখিয়েছি, গাছ কাটতে নেই, লাগাতে হয়৷
     বছর তিনেক আগে হঠাৎ দেখলাম আমাদের আসাম রোড (এস টি কে কে রোড )  চওড়া করার জন্য শতাব্দী প্রাচীন ( হয়ত বা কয়েক শতাব্দী প্রাচীন ) বিরাট বিরাট শিরীষ গাছগুলিকে নির্মমভাবে কেটে ফেলা হলো কোনো নতুন গাছ না লাগিয়েই৷ আমার মেয়ে তিতলি আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘‘বাবা , গাছ কাটা তো খারাপ কাজ, তাহলে এতগুলো গাছ কেটে ফেলল কেন?'' বিশ্বাস করুন, আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি৷ কীভাবে তাকে আমি বলব যে, বড় হলে আমাদের মধ্যে একটা জিনিস জন্ম নেয় যার নাম ‘হিপোক্রেসি'৷ যতক্ষণ না আমরা এই হিপোক্রেসির হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছি, ততক্ষণ আমাদের কথা আর কাজের মধ্যে রয়ে যাবে বিস্তর ফারাক৷ আমরা অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে চলি, ‘কর্তব্য বিষয়ে ভালো ভালো কথার জন্ম হয়েছে আমার বলার জন্য, আর অন্যদের করার জন্য', অন্তত আমার দেশে৷ তাই আমরা স্লোগান দিই, ‘গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান'৷ কখনোই বলি না, ‘এসো গাছ লাগাই, প্রাণ বাঁচাই'৷ আমাদের বাসের পিছনে লেখা থাকে না, ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলি', লেখা থাকে ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন'৷  অর্থাৎ আমার কোনো দায় নেই! আজ আমাদের এস টি কে কে রোড ঝাঁ চকচকে,গাড়ী চলে সাবলীল ভাবে ,বান্ডেল থেকে কাটোয়া পর্যন্ত রাস্তা শুয়ে আছে একটা বড়ো অজগরের মতো,গাড়ি চলছে সাঁ সাঁ করে ,.........ঠা ঠা রোদ্দুরে অজগরের পিঠ চক চক করছে ,আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের সেই ছায়া - সুনিবিড় পথ। খামারগাছী পেরোলেই চোখে পড়ে রাস্তার ধারে পরে আছে শিরীষ ,বাবলা,জারুল,কৃষ্ণচূড়াদের টুকরো টুকরো লাশ।
       তবুও আশার কথা, সর্বত্রই কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ থাকেন, কথা নয়, কাজই যাঁদের জীবনাদর্শ৷ তাঁদের কাজের ফলেই সভ্যতা কালো থেকে আলোর দিকে, মন্দ থেকে ভালোর দিকে এগিয়ে চলে৷ তাঁদের কথা মনে রেখেই আমরা নিজেদের সন্তান-সন্ততির জন্য আগামীদিনে একটু অন্যরকম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে সাহস পাই৷

বিশ্ব পরিবেশ দিবস প্রতি বছরই আসে, আবার চলেও যায়। এই দিনটি পালন করার সময় পরিবেশ সচেতনতার কথা বলেন অনেকেই। তারপরই পরিবেশ রক্ষার কথা ভুলে যায় সবাই। তবুও  কিছু মানুষ বাঁচে নিজের মতো করে সবুজকে সাথে নিয়ে। 

শনিবার, ৩ জুন, ২০১৭

কুরচি

"কশ্চিত্ কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারাত্প্রমত্তঃ
শাপেনাস্তঙ্গমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেণ ভর্তুঃ .
যক্ষশ্চক্রে জনকতনযাস্নানপুণ্যোদকেষু
স্নিগ্ধচ্ছাযাতরুষু বসতিং রামগির্যাশ্রমেষু ..
তস্মিন্নদ্রৌ কতিচিদবলাবিপ্রযুক্তঃ স কামী
নীত্বা মাসান্ কনকবলযভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠঃ .
আষাঢস্য প্র(শ)থমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীডাপরিণতগজপ্রেক্ষণীযং দদর্শ ..
তস্য স্থিত্বা কথমপি পুরঃ কৌতুকাধানহেতোঃ
অন্তর্বাষ্পশ্চিরমনুচরো রাজরাজস্য দধ্যৌ .
মেঘালোকে ভবতি সুখিনোঽপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ
কণ্ঠাশ্লেষপ্রণযিনি জনে কিং পুনর্দূরসংস্থে ..
প্রত্যাসন্নে নভসি দযিতাজীবিতালম্বনার্থী
জীমূতেন স্বকুশলমযীং হরযিষ্যন্ প্রবৃত্তিম্ .
স প্রত্যগ্রৈঃ কুটজকুসুমৈঃ কল্পিতার্ঘায তস্মৈ
প্রীতঃ প্রীতিপ্রমুখবচনং স্বাগতং ব্যাজহার .. " মেঘদুতম ( Meghaduuta
Kalidasa’s Cloud Messenger)
হিমালয় পর্বতের মানস সরোবরের সন্নিকটে অলকাপুরী নামে এক মনোরম রাজ্য ছিল। তার অধিপতি কুবের। এদের বলা হতো দেবতা [আসলে মানুষ]। স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সুখী। সেই কুবের রাজার এক কর্মচারী যক্ষ একদিন বাগান পাহারার কাজে অবহেলা করেছিল। সেই অপরাধে তাকে এক বছরের জন্য নির্বাসন দিয়ে পাঠিয়ে দিল বিন্ধ্য পর্বতের রামগিরিতে। ওদিকে ঘরে, একাকিনী প্রিয়া। নির্বাসনে আট মাস কোনোমতে কেটে গেল। এসে গেছে বর্ষা। মৌসুমি মেঘ চলেছে উত্তর দিকে হিমালয়ে। অমনি যক্ষ ঠিক করল মেঘকে দূত করে খবর পাঠাবে প্রিয়তমার কাছে। তখন, হাজার দেড়েক বছর আগে ডাক বিভাগ ছিল না। মেঘ ছাড়া কে খবর নিয়ে যেতে পারবে? যক্ষ তাই বসন্ত-গ্রীষ্মে ফোটা কুর্চি ফুল দুই হাতে নিয়ে মেঘকে 'মোহন, প্রীতিময় বচনে' জানাল তার দুঃখের কথা। এই নিয়ে কালিদাস লিখেছেন 'মেঘদূত' নামক বিখ্যাত কাব্য। গ্রীষ্ম-বর্ষার এত ফুল থাকতে কুর্চি ফুল কেন বেছে নিলেন কালিদাস বা তাঁর নায়ক যক্ষ নামক সাধারণ মানুষটি! বিরহী যক্ষ নবীন মেঘ দেখে বলছে...............
'কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে যদি-না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গল-বার্তা? যক্ষ অতএব কুড়চি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য স্বাগত-সম্ভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।'
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও কুড়চির সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলেন , তিনি তাঁর বনবানী গ্রন্থে লিখেছিলেন.................. " অনেককাল পূর্বে শিলাইদহ থেকে কলকাতায় আসছিলেম। কুষ্টিয়া স্টেশনঘরের পিছনের দেয়ালঘেঁষা এক কুরচিগাছ চোখে পড়ল । সমস্ত গাছটি ফুলের ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত। চারি দিকে হাটবাজার ; এক দিকে রেলের লাইন , অন্য দিকে গোরুর গাড়ির ভিড় , বাতাস ধুলোয় নিবিড়। এমন অজায়গায় পি.ডব্লু.ডি-র স্বরচিত প্রাচীরের গায়ে ঠেস দিয়ে এই একটি কুরচিগাছ তার সমস্ত শক্তিতে বসন্তের জয়ঘোষণা করছে— উপেক্ষিত বসন্তের প্রতি তার অভিবাদন সমস্ত হট্টগোলের উপরে যাতে ছাড়িয়ে ওঠে এই যেন তার প্রাণপণ চেষ্টা । কুরচির সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয়।
ভ্রমর একদা ছিল পদ্মবনপ্রিয় ,
ছিল প্রীতি কুমুদিনী পানে ।
সহসা বিদেশে আসি , হায় , আজ কি ও
কূটজেও বহু বলি মানে!
পদ্মফুলে কে না মুগ্ধ? কিন্তু কুরচিতে? ভ্রমর নাকি পদ্ম ভুলে কুরচির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। সে অপরাধের খাড়া পড়ল কুরচির উপর। অপরাধ তার আরও ছিল বৈ কি! চিরবসন্ত-স্বর্গে মহেন্দ্রের নন্দনকাননে শ্বেতশুভ্র ফুলের প্রতীক ছিল কুরচি। ইন্দ্রাণীর কবরী সজ্জায় সে অপরিহার্য, পারিজাতমঞ্জরির লীলাসঙ্গীও। “পুর্ণিমার অমল চন্দনে” চর্চিত কুরচি আন্দোলিত হত নৃত্যরতা অপ্সরীর মণিবন্ধে। তাকে কিনা এক বেদেনি চুরি করে নিয়ে এল ধূলার ধরায়, আর নাম ভাড়িয়ে লুকিয়ে রাখল ঘরের কানাচে!
শ্বেতভুজা ভারতীয় বীণা এই আভিজাত্যহীনা, নামের গৌরবহারা কুরচিকে অলংকারঝংকারিত কাব্যের মন্দিরে অভ্যর্থনা করে নি। শুভদৃষ্টি ঘটে নি, ঔদাস্যে অবহেলায় তাই কুণ্ঠিতা কুরচি। সে লজ্জায় বিমূঢ় রবীন্দ্রনাথ,
“আমি কবি লজ্জা পাই কবির অন্যায় অবিচারে
হে সুন্দরী। শাস্ত্রদৃষ্টি দিয়ে তারা দেখেছে তোমারে,
রসদৃষ্টি দিয়ে নহে;”
হায়! এ জগতে শাস্ত্রদৃষ্টি কতই না অনাচার ঘটায় ! বেদেনির স্পর্শ কি তবে কুরচিকে অস্পৃশ্য করেছিল? মূল্যহীন তাঁর কাছে রসদৃষ্টি, পোয়েটিক জাস্টিস! কিন্তু কবি সদম্ভে ঘোষণা করেন তাঁর অবস্থান। তাঁর পক্ষপাত কুরচির প্রতিই,
— সংস্কৃত শ্লোকের অনুবাদ
কুরচি , তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা
যে ভ্রমর , শুনি নাকি তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা ।
আমি সেই ভ্রমরের দলে । তুমি আভিজাত্যহীনা ,
নামের গৌরবহারা ; শ্বেতভুজা ভারতীয় বীণা
তোমারে করে নি অভ্যর্থনা অলংকারঝংকারিত
কাব্যের মন্দিরে । তবু সেথা তব স্থান অবারিত ,
বিশ্বলক্ষ্মী করেছেন আ মন্ত্রণ যে প্রাঙ্গণতলে
প্রসাদচিহ্নিত তাঁর নিত্যকার অতিথির দলে ।
আমি কবি লজ্জা পাই কবির অন্যায় অবিচারে
হে সুন্দরী । শাস্ত্রদৃষ্টি দিয়ে তারা দেখেছে তোমারে ,
রসদৃষ্টি দিয়ে নহে ; শুভদৃষ্টি কোনো সুলগনে
ঘটিতে পারে নি তাই , ঔদাস্যের মোহ-আবরণে
রহিলে কুণ্ঠিত হয়ে ।
তোমারে দেখেছি সেই কবে
নগরে হাটের ধারে জনতার নিত্যকলরবে ,
ইঁটকাঠপাথরের শাসনের সংকীর্ণ আড়ালে ,
প্রাচীরের বহিঃপ্রান্তে। সূর্যপানে চাহিয়া দাঁড়ালে
সকরুণ অভিমানে; সহসা পড়েছে যেন মনে
একদিন ছিলে যবে মহেন্দ্রের নন্দনকাননে
পারিজাতমঞ্জরির লীলার সঙ্গিনীরূপ ধরি
চিরবসন্তের স্বর্গে, ইন্দ্রাণীর সাজাতে কবরী;
অপ্সরীর নৃত্যলোল মণিবন্ধে কঙ্কণবন্ধনে
পেতে দোল তালে তালে; পুর্ণিমার অমল চন্দনে
মাখা হয়ে নিঃশ্বসিতে চন্দ্রমার বক্ষোহার-'পরে।
অদুরে কঙ্কররুক্ষ লৌহপথে কঠোর ঘর্ঘরে
চলেছে আগ্নেয়রথ, পণ্যভারে কম্পিত ধরায়
ঔদ্ধত্য বিস্তারি বেগে; কটাক্ষে কেহ না ফিরে চায়
অর্থমূল্যহীন তোমা-পানে, হে তুমি দেবের প্রিয়া,
স্বর্গের দুলালী। যবে নাটমন্দিরের পথ দিয়া
বেসুর অসুর চলে, সেইক্ষণে তুমি একাকিনী
দক্ষিণবায়ুর ছন্দে বাজায়েছ সুগন্ধ-কিঙ্কিণী
বসন্তবন্দনানৃত্যে-- অবজ্ঞিয়া অন্ধ অবজ্ঞারে,
ঐশ্বর্যের ছদ্মবেশী ধূলির দুঃসহ অহংকারে
হানিয়া মধুর হাস্য; শাখায় শাখায় উচ্ছ্বসিত
ক্লান্তিহীন সৌন্দর্যের আত্মহারা অজস্র অমৃত
করেছে নিঃশব্দ নিবেদন।.........

মোর মুগ্ধ চিত্তময়
সেইদিন অকস্মাৎ আমার প্রথম পরিচয়
তোমা-সাথে। অনাদৃত বসন্তের আবাহন গীতে
প্রণমিয়া উপেক্ষিতা, শুভক্ষণে কৃতজ্ঞ এ চিতে
পদার্পিলে অক্ষয় গৌরবে। সেইক্ষণে জানিলাম,
হে আত্মবিস্মৃত তুমি, ধরাতলে সত্য তব নাম
সকলেই ভুলে গেছে , সে নাম প্রকাশ নাহি পায়
চিকিৎসাশাস্ত্রের গ্রন্থে, পণ্ডিতের পুঁথির পাতায়;
গ্রামের গাথার ছন্দে সে নাম হয় নি আজও লেখা,
গানে পায় নাই সুর। সে নাম কেবল জানে একা
আকাশের সূর্যদেব, তিনি তাঁর আলোকবীণায়
সে নামে ঝংকার দেন, সেই সুর ধুলিরে চিনায়
অপূর্ব ঐশ্বর্য তার; সে সুরে গোপন বার্তা জানি
সন্ধানী বসন্ত হাসে। স্বর্গ হতে চুরি করে আনি
এ ধরা, বেদের মেয়ে, তোরে রাখে কুটির-কানাচে
কটুনামে লুকাইয়া, হঠাৎ পড়িস ধরা পাছে।
পণ্যের কর্কশধ্বনি এ নামে কদর্য আবরণ
রচিয়াছে; তাই তোরে দেবী ভারতীর পদ্মবন
মানে নি স্বজাতি বলে, ছন্দ তোরে করে পরিহার--
তা বলে হবে কি ক্ষুণ্ন কিছুমাত্র তোর শুচিতার।
সূর্যের আলোর ভাষা আমি কবি কিছু কিছু চিনি,
কুরচি, পড়েছ ধরা, তুমিই রবির আদরিণী।"
“নগরে হাটের ধারে, জনতার নিত্যকলরবে,
ইঁটকাঠপাথরের শাসনের সংকীর্ণ আড়ালে,
প্রাচীরের বহিঃপ্রান্তে।”
যার অঢেল উপস্থিতি, তাকে নিশ্চই সকলেই ভোলে নি।”জনতার নিত্যকলরবে” কুরচি ঠিকই আছে আপন মহিমায়। তাই থাক না কিছু ভুল ভাল কাব্যকৃতিতে! কতটুকু ক্ষতি তাতে? মূলবাণী পেয়ে গেছি রবীন্দ্রনাথেই। দেবী ভারতীর পদ্মবন স্বজাতি বলে না মানুক, ছন্দ তাকে যতই পরিহার করুক তাতে কুরচির শুচিতা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয় নি। দেবের প্রিয়া, স্বর্গের দুলালী কুরচিকে ঠিকই চিনেছেন সূর্যদেব। কবি তাই নিশ্চিন্ত হন,
“সূর্যের আলোর ভাষা আমি কবি কিছু কিছু চিনি,
কুরচি, পড়েছ ধরা, তুমিই রবির আদরিণী।”
এখানে আবার দেখি সূর্যদেব আর কবি রবি একাকার! কার আদরিণী কুরচি? শুধুই সূর্যদেব রবির, না-কি কবিরও যার নাম রবি?
ভারতবর্ষের আদি নিবাসী কুরচি ক্ষুদ্র আকৃতির বৃক্ষ। কাণ্ড সরল, বাকল অমসৃণ ও হালকা ধূসর রঙের। অজস্র ঊর্ধ্বমুখী শাখায় এলোমেলো। পাতা লম্ব-ডিম্বাকৃতির, মসৃণ এবং উভয়ের বিপরীত দিকে সমভাবে বিন্যস্ত থাকে। শীতে পত্রহীন হয়, ফাল্গুনের শেষভাগে দুয়েক স্তবক ফুল ফুটতে শুরু করে।
ফুল, বাকল ও ফল আমাশয়ের ওষুধ। তাছাড়া ফুল রক্তদোষে, পাতা বাত ও ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসে, বীজ অর্শ্ব ও একজিমায় উপকারী। সর্পদংশন এবং বিছার কামড়েও এ গাছের বাকল ব্যবহার করা হতো। নরম কাঠ থেকে পুতুল ও খেলনা তৈরি হয়।
কুরচির অন্যান্য নাম- কুটজ, ইন্দ্রযব, ইন্দ্রজৌ, বৎসক, কলিঙ্গ, প্রাবৃষ্য, শত্রুপাদপ, সংগ্রাহী, পান্ডুরদ্রুম, মহাগন্ধ, ইংরেজিতে Bitter Oleander, Easter Tree।
আকৃতিতে কামিনীর সাথে বেশ মিল, বর্ণেও। তবু কামিনীর সলাজ ঝরে পড়ার সাথে কুরচির বেমিল নজর কাড়ে। বসন্তে সে প্রস্ফূটনে মাতে, থাকে সমস্ত গ্রীষ্মব্যাপী, বর্ষণসিক্ত হয়ে তার প্রস্ফুটনে যতি। প্রথম পর্বে, বসন্তে শুধুই তুষারধবল কুরচিতে মোড়া নিষ্পত্র তরুটি। দিন যত দীর্ঘতর হয়, উত্তাপ যত বাড়ে, গ্রীষ্মের আগমনে সবুজ পাতা আর সাদা ফুলে লুকোচুরির মনোহরণ দৃশ্য যে দেখে সেই মজে। এদেশে এমন শ্বেত, তুষারধবল ফুলের অক্লান্ত দীর্ঘস্থায়ী প্রস্ফূটনের বন্যা বেশি নেই। কুরচি তাই আমাদের প্রিয় ফুলের তালিকাশীর্ষে স্থান পেতেই পারে।
আমাদের ওঙ্কার ধামের প্রথম কুড়চি গাছটি আমার মায়ের লাগানো , গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় কামিনী ও কুড়চির সুগন্ধি যুগলবন্দী প্রান ভরিয়ে দেয় .........
বসন্তে নিষ্পত্র তরুজুড়ে বরফশুভ্র এমন অনিন্দ্য সুন্দর পুষ্প এ বাংলায় দ্বিতীয়টি নেই।এমন তুষারধবল, প্রস্ফূটনে ক্লান্তিহীন কুরচিকে আমরা আমাদের নাগরিক জীবনে আনন্দের উৎসে পরিণত করতে পারি। আমাদের উদ্যান চর্চায় কেন তবে কুরচি অবহেলিত থাকবে? আসুন, সবাই মিলে এই অপরূপ শ্বেতশুভ্র পুষ্পে ভরে তুলি আমাদের স্বপ্নের বাড়ি,স্বপ্নের নগর,...............

শুক্রবার, ২ জুন, ২০১৭

অনন্তলতা

গুহাযুগ থেকে আজ ,অনন্তকাল ধরে তুমি আছো ,
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ স্নিগ্ধতা নিয়ে,
 হে অনন্তলতা ।
কি আশ্চর্য প্রানসক্তি , অনন্তকাল ধরে  টিকে আছো স্বমহিমায়, তুমি বারবার 
বেঁচে ওঠো ফিনিক্স পাখির মত !
আমাকে চেনা , দেখার  ভালবাসার পর আর
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হয় না আমার,  তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
পুস্পিত করে তুলেছ গুহামানবের গুহা থেকে ,আমার শখের বাগান।
 ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ,
শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন আমার বাগানে
 আমার হাত ছুঁয়ে যাও, তখন আমার মনে হয় এ-শহর, আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতায়,   একটি নীলিমার-ছোঁয়া। ......।
ছবি- কবিতা নাসরিন সৃষ্টি 


আজকের  পপকর্নকে আমরা প্রায় সবাই চিনি , অনন্তলতার রূপসী ফলের দেহে লেখা আছে আধুনিক পপকর্ন আর সনাতন খইয়ের ইতিহাস। প্রত্নত্ত্ববিদরা পপকর্নের যে অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন তা কমপক্ষে ৮০ হাজার বছর আগেকার, অর্থাৎ গুহাবাসীরাও পপকর্নের ব্যবহার জানতো। ৫৬০০ বছর আগেকার মেক্সিকোর বাদুড় অধ্যুষিত গুহায় (Bat Cave) পাওয়া গেছে অনন্তলতার বীজের অস্তিত্ব। প্রাচীনকালে অনন্তলতার খই ছিল এক ধরনের দরকারি খাবার।শুধু খাবার নয়,সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত, নানা রকম চিকিৎসায় বিভিন্ন দেশে (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ঠান্ডাজনিত রোগে) অনন্তলতার  ব্যবহার দেখা যায়।


ছবি - গুগল
 অনন্ত কাল ধরে স্বমহিমায় টিকে আছে অদ্যাবধি, সে কারণে অনন্তলতা। সুন্দর ফুল দেখে যুগে যুগে আবেগী মানুষ লাভ চেইন, লাভ ভাইন, আরো কতো রোম্যান্টিক বিশেষণে ভূষিত করেছে তাকে। যদিও শোভাবর্ধক লতা হিসাবে এর খুব একটা জনপ্রিয়তা নেই। আমাদের  সখের বাগানে খুব একটা চোখে পড়ে না। বরং আগাছা হিসাবেই এর পরিচিতি বেশি। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে আগাছা হিসেবে এরা চরম আকার ধারণ করেছে। অস্ট্রেলিয়া, ফ্লোরিডাতে চিহ্নিত হয়েছে আগ্রাসী আগাছা (Exotic Pest Control Council, Florida) হিসেবে। আদিবাস মেক্সিকো থেকে সারা দুনিয়াতে এই গাছ ছড়িয়েছে কচুরি পানার মতো। প্রচন্ড মৃত্তিকা ও বায়ু দূষণের মধ্যেও বছর বছর ধরে বহাল তবিয়তে টিকে থাকে এরা। যে কোন গাছকে জড়িয়ে, পাঁচিল বা বাড়ির ছাদে অনন্তলতা অহরহ দেখা যায়। লতানো স্বভাবের হওয়ায় যে কোনো বাহন পেলেই অনেকদূর অবধি উঠতে পারে। প্রস্ফুটন প্রাচুর্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সব ধরনের বাগানেই এ গাছ আদর্শ। তাছাড়া বিশেষ উদ্যানশৈলীর ক্ষেত্রেও বিভিন্ন নকশায় এ গাছ উপস্থাপন করা যায়।

   গ্রীষ্মকালের শুরু থেকে তবে থাকে বর্ষা-শরত্ অবধি,থেকে যায় অনন্তলতার ফুল ফোটার  রেশ । পাঁচটি পাঁপড়ি যুক্ত। ফুলের রূপ সহজে ম্লান হয় না।ফুল দেখতে ছোট হলেও বৃত্যাংশ বড় হয়।ফুলের আদল অনেকটা বাগানবিলাস বা বগেনভলিয়ার মত, তবে অনেকটাই  ছোটো , অনেকেই বৃত্যাংশকেই ফুল বলে ভুল করে থাকে। অন্যান্য দেশে এর প্রকারভেদ থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণত সাদা ও গাঢ় লাল বা গোলাপি রঙের ফুল দেখা যায়। গোলাপি রঙের ফুলের বৃত্যাংশ পাঁচটি ও রঙিন।

একটু দূর থেকে গাছ দেখে মনে হয়, গাছে বুঝি ফল ধরে না। অথচ সারা গাছে ধরে থাকে ৪-৬ মিলিমিটারের ছোটো ছোটো  ফল দেখতে অনেকটা আমাদের ছেলেবেলায় খেলা লাট্টুর মতো । ফলগুলি লুকিয়ে থাকে ফুলের ৫ পাঁপড়ির নিচে, খানিকটা ভাঁট ফুল ও ফলের মতো ।
ছবি - কবিতা নাসরিন সৃষ্টি

 এর বংশবিস্তার সাধারনত বীজ ও কন্দ থেকে হয়। বীজগুলো জলে ভাসে, ভেসে চলে যায় দূরে। ডাঙ্গার দেশে পাখিরা খায়, হরিণ, ছাগল জাতীয় তৃণভোজী প্রাণী ও বাদুর জাতীয় প্রাণীরও খাদ্য। খাবারের মাধ্যমে বীজ চলে যায় আরেক জায়গায়। গাছ ধ্বংস হয়ে গেলেও আগুন লেগে ছাই হয়ে যায় চারদিক কিন্তু গাছের নিচের কন্দ আর সাকার-রুট (Succer Root) থেকে নতুন করে জন্ম হয় অক্ষয় অনন্তলতার।


শনিবার, ২৭ মে, ২০১৭

বাংলার পুস্পিত বৃক্ষ

পৃথিবীর অন্যতম উর্বর ভূখণ্ড এই বাংলায় স্বাভাবিক উদ্ভিদের সংখ্যা অজস্র। সেই উদ্ভিদরাজ্যে ফুলেল বৃক্ষের সংখ্যাও অগুনতি। তাতে তৃণ থেকে মহিরুহের কমতি নেই, কিন্তু অপরিণামদর্শীদের কবলে পড়ে রবীন্দ্রনাথ,নজরুল ও জীবনানন্দের সোনার বাংলা অনেকটাই শ্রীহীন।

লাল সোনাইল

  আমি মনে করি, বন বিভাগ ও উদ্যান উন্নয়ন বিভাগ এগিয়ে এলে এ সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। স্বল্প মূল্যে ও সহজলভ্য বৃক্ষের কি সত্যিই আকাল পড়েছে দেশে? গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সঠিক বৃক্ষ নির্বাচন। বসন্তে পল্লিবাংলা লাল শিমুলে ভরে উঠলেও নগরে তার যেন কোনো প্রবেশাধিকার নেই। নগরে পারিজাত তো ব্রাত্যই, গ্রামেও এখন এর কদর কম।

 শহর আলো করে তুলতে পারত অশোক। এই অসাধারণ সুন্দর উজ্জ্বল ফুল ও পল্লবশোভিত, ভেষজ তরুটিকেও আমরা নগরে লালন করতে চাই না। এককালে কুসুম ফুলে ভরে থাকত নদীবিধৌত বাংলা। এখন এর নামটিও হারিয়ে যাচ্ছে। পলাশ একে ক্ষণস্থায়ী, তাতে নগর সৌন্দর্যায়ণে তার তেমন কদর নেই, যতটা আছে কবিতায়, সাহিত্যে। প্রস্ফুটনের প্লাবন ও ঔজ্জ্বল্যে পলাশের সঙ্গে তুলনীয় এক বাসন্তিকা অপ্রিয় গন্ধি জংলি বাদাম। দ্বিজেন শর্মার ভাষায়, ‘শুধু প্রস্ফুটনের অপ্রিয় গন্ধের প্রসঙ্গ বাদ দিলে ঋজুতা, বলিষ্ঠতা ও সৌন্দর্যে ছায়ানিবিড় এই বৃক্ষটি আমাদের তরুরাজ্যের যোগ্য প্রতিনিধি।’
কাঞ্চনও কেন দুর্লভ এই মহানগরে? নানা রঙের কাঠগোলাপও কেন চোখ কাড়ে না? শীত-বসন্তে আলো ছড়ায় আফ্রিকান টিউলিপ, কোনো বিলাসীর বাড়ির আঙিনায় হয়তো তার ঠাঁই আছে, কিন্তু নগরজীবনে এর  উপস্থিতি অনেক কম। গত বসন্তে কলকাতা শহরের কিছু অংশে আলো করে থাকতে দেখলাম আফ্রিকান টিউলিপ, রুদ্রপলাশ, জারুল ও কনকচূড়া কে ... মন ভরে গেল ।

জাকারান্ডা, নাগলিঙ্গম রাজধানীর প্রিয় তরু হবে না কেন? এর পাশে থাকুক বোতল ব্রাশও। আমাদের নগর সৌন্দর্যায়ণে বরফশুভ্র কুরচি কেন স্থান পাবে না?

 কুরচির সৌন্দর্যে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ঐশ্বর্যের ছদ্মবেশী ধূলির দুঃসহ অহংকারে/ হানিয়া মধুর হাস্য; শাখায় শাখায় উচ্ছ্বসিত/ ক্লান্তিহীন সৌন্দর্যের আত্মহারা অজর অমৃত/ করেছ নিঃশব্দে নিবেদন।’ কিন্তু না,  শহরে কুরচির সাদর রোপণ চোখে পড়ে না। নিতান্ত অবহেলায় সে জন্মে দেশের নানা প্রান্তে, থাকেও যেন অপরিচিত, বিশেষত ভদ্রসমাজে।
 বাংলা তো শাল-পিয়ালের দেশ।  লালমাটির আত্মজ ঋজু শালবৃক্ষ কেন নির্বাসিত থাকবে আমাদের শহর থেকে......? ফাল্গুনে নিষ্পত্র হয়ে কোমল, রোমশ সাদা দীর্ঘ মঞ্জরিতে আচ্ছন্ন হয়ে ‘সৌরভধনে তখন তুমি হে শালমঞ্জরী বসন্তে কর ধন্য।’
অঞ্জন

গ্রীষ্মে বাংলাদেশ পত্রপল্লবে সুশোভিত হয়। তপ্ত ধরণি নববর্ষায় সিক্ত হয়ে উদ্ভিদরাজ্যে নবজীবনের সঞ্চার করে। গ্রীষ্মের সবচেয়ে উজ্জ্বল পুষ্প নিঃসন্দেহে কৃষ্ণচূড়া। তার পাশেই আমাদের একান্ত দেশীয় পুষ্প জারুল আর সোনালু আমাদের ক্লান্ত জীবনকে বর্ণিল করে তোলে। এই ত্রিরত্ন কেন সারা বাংলার সমস্ত রাজপথ জুড়ে ওদের সৌন্দর্যের দ্যুতি ও স্নিগ্ধ ছায়া ছড়াবে না? কেরালা, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, হায়দরাবাদ যদি এই তিনের সমারোহে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে, আমার সোনার বাংলা  পারে না কেন?
একসময় বর্ধমান জেলার কালনা শহর থেকে হুগলী জেলার প্রাচীন শহর পান্ডুয়া পর্যন্ত রাস্তার (কালনা পান্ডুয়া রোড) দুই ধার  অরুণাভ পত্রঘন নাগেশ্বরে আর বিভিন্ন আমগাছে ভরে ছিল, চিরহরিৎ, নিশ্ছিদ্র ও ছায়ানিবিড় অপরূপ সৌন্দর্যময় এই দেশীয় তরু কী কারণে বৃক্ষ হন্তারকদের লোভ ও ক্রোধের শিকার হলো? উষ্ণায়ণ রোধে, সৌন্দর্যায়ণে কেন নাগেশ্বর আমাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে স্থান পাবে না?
 একটা ব্যক্তিগত কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার কথা বলি৷ আমার বাচ্চাকে শিখিয়েছি, গাছ কাটতে নেই, লাগাতে হয়৷
     বছর তিনেক আগে হঠাৎ দেখলাম আমাদের আসাম রোড (এস টি কে কে রোড )  চওড়া করার জন্য শতাব্দী প্রাচীন ( হয়ত বা কয়েক শতাব্দী প্রাচীন ) বিরাট বিরাট শিরীষ গাছগুলিকে নির্মমভাবে কেটে ফেলা হলো কোনো নতুন গাছ না লাগিয়েই৷ আমার মেয়ে তিতলি আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘‘বাবা , গাছ কাটা তো খারাপ কাজ, তাহলে এতগুলো গাছ কেটে ফেলল কেন?'' বিশ্বাস করুন, আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি৷ কীভাবে তাকে আমি বলব যে, বড় হলে আমাদের মধ্যে একটা জিনিস জন্ম নেয় যার নাম ‘হিপোক্রেসি'৷ যতক্ষণ না আমরা এই হিপোক্রেসির হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছি, ততক্ষণ আমাদের কথা আর কাজের মধ্যে রয়ে যাবে বিস্তর ফারাক৷ আমরা অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে চলি, ‘কর্তব্য বিষয়ে ভালো ভালো কথার জন্ম হয়েছে আমার বলার জন্য, আর অন্যদের করার জন্য', অন্তত আমার দেশে৷ তাই আমরা স্লোগান দিই, ‘গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান'৷ কখনোই বলি না, ‘এসো গাছ লাগাই, প্রাণ বাঁচাই'৷ আমাদের বাসের পিছনে লেখা থাকে না, ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলি', লেখা থাকে ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন'৷  অর্থাৎ আমার কোনো দায় নেই! আজ আমাদের এস টি কে কে রোড ঝাঁ চকচকে,গাড়ী চলে সাবলীল ভাবে ,বান্ডেল থেকে কাটোয়া পর্যন্ত রাস্তা শুয়ে আছে একটা বড়ো অজগরের মতো,গাড়ি চলছে সাঁ সাঁ করে ,.........ঠা ঠা রোদ্দুরে অজগরের পিঠ চক চক করছে ,আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের সেই ছায়া - সুনিবিড় পথ। খামারগাছী পেরোলেই চোখে পড়ে রাস্তার ধারে পরে আছে শিরীষ ,বাবলা,জারুল,কৃষ্ণচূড়াদের টুকরো টুকরো লাশ।
 গাছগাছালি মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শুধু মানুষই নয়, গাছপালা ছাড়া কোনো প্রাণীই জীবন ধারণ করতে পারবে না। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বেড়ে পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধানত দায়ী বৃক্ষহীনতা। দিন দিন কমে যাচ্ছে গাছের সংখ্যা। গাছপালার স্বল্পতার কারণে ভূপৃষ্ঠে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ভয়াবহভাবে বেড়ে যাচ্ছে। গাছগাছালির উপকারের কোনো শেষ নেই। একটি গাছ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে।
 উষ্ণায়ণ রোধে  আমাদের বৃক্ষরোপণ পরিকল্পনায় কাঠবাদাম ও কদমকে অবশ্যই স্থান দিতে হবে। সেই সঙ্গে নিম ও বকুলকেও। কেন আবর্জনায় ক্লিষ্ট, দুর্গন্ধময় এই শহরে প্রচুর ছাতিম থাকবে না? তেলশুর, পাদাউক প্রাধান্য পায় না কেন? মহাশিরীষ, গগনশিরীষ, হিজল, তমাল, দেবদারু, অশ্বত্থ, উদয়পদ্ম, গাব, গামারি, হরেক রকম চাঁপা, বরুণ, বুদ্ধনারকেল, মহুয়া, মুচকুন্দ, চন্দন ইত্যাদি বৃক্ষের ব্যাপক ও পরিকল্পিত রোপণ কাঙ্ক্ষিত।
বছর কয়েক আগের কথা , আমার মেয়ে তিতলি তখন দশম শ্রেণী , আমাদের ব্লক এ নগরায়ন ও সবুজ নিয়ে একটি আন্তঃ স্কুল বিতর্কের আয়োজন করা হয়েছিল , তিতলির তাতে অংশগ্রহণ করেছিল । অনুষ্ঠান টি হয়েছিল আমাদের বাড়ি থেকে একটু দুরে(১৪ কিমি) কামারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেদিন আমার ছুটির দিন থাকায় আমরা (স্ত্রী স্বাতী ও তিতলি) হাজির হলাম ওই বিদ্যালয়ে । সারা স্কুল জুড়ে সবুজের সমারোহ , কেয়ারি করা বাগান ! প্রধান শিক্ষকের সাথে আলাপ হতেই তিনি নিজে আমাদের সারা বিদ্যালয় ও বাগান ঘুরিয়ে দেখালেন । আমলকী ,হরিতকি, তমাল, রুদ্রপলাশ, মহাশিরীষ, গগনশিরীষ, হিজল, , দেবদারু, অশ্বত্থ, উদয়পদ্ম, গাব, গামারি, হরেক রকম চাঁপা, বরুণ, বুদ্ধনারকেল, মহুয়া, মুচকুন্দ, চন্দন, শ্বেত শিমুল, কি নেই সেখানে !!! মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেল । ওনার মত বিনয়ী মানুষ বেশ কম , উনি  এ বাগানের সৌন্দর্যের কৃতিত্ব সবটুকুই ওনার ছাত্র ছাত্রীদের দিলেন ।
 যখন সারা বাংলা জুড়ে বৃক্ষ নিধন ও নগরায়ন চলছে , তখন তিনি নিঃশব্দে ছোটছোট ছেলে মেয়েদের (পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণী) নিয়ে গড়ে তুলেছেন, সবুজের সমারোহ , পাখিদের আবাসস্থল ।
সর্বত্রই কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ থাকেন, কথা নয়, কাজই যাঁদের জীবনাদর্শ৷ তাঁদের কাজের ফলেই সভ্যতা কালো থেকে আলোর দিকে, মন্দ থেকে ভালোর দিকে এগিয়ে চলে৷ তাঁদের কথা মনে রেখেই আমরা নিজেদের সন্তান-সন্ততির জন্য আগামীদিনে একটু অন্যরকম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে সাহস পাই৷





   আমার সোনার বাংলা সেজে উঠুক অর্জুন, আমলকী, বহেড়া, খুদে জাম, টক আম, কালোজাম, ক্ষীর খেজুর, গোলাপজাম, চালতা, জলপাই, বাতাবি লেবু, আমড়া, তেঁতুলের মতো ভেষজ ও ফলদ বৃক্ষে। রাস্তার দুই পাশে গাছে গাছে শোভা পাক নানা রঙের অর্কিড, নাগানবিলাস, মধুমঞ্জরিসহ গোল্ডেন শাওয়ার, ঝুমকো লতা, হানিমুন ক্রিপার, আইভি লতা, টেকুমা ইত্যাদি।

ফুলের কথা উঠলে আগে আসে ঋতুরাজ বসন্তের কথা। কিন্তু গ্রীষ্মেও  ফোটে নানা রঙের বাহারি ফুল। প্রচণ্ড দাবদাহে কিছুটা হলেও প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় এসব ফুল। হলুদ সোনালু, বেগুনি জারুল ও লাল কৃষ্ণচূড়া এদের মধ্যে অন্যতম।
এছাড়া গ্রীষ্মে ফোটে আরো নানা ফুল। এদের মধ্যে কাঁটার মুকুট বা ক্রাউন অব থর্ন, গন্ধরাজ, লাল চাঁপা, সাদা চাঁপা, চুলের বেণির মতো গোলাপি অর্কিড ও মে ফ্লাওয়ার সহ কত কী!
গ্রীষ্মের চোখ জুড়ানো বর্ণিল ফুল বাঙ্গালী মনকে নাড়া দেয় খুব গভীরভাবে। ইট পাথরের শহর ছেড়ে একটু গ্রামীণ প্রকৃতির কাছে গেলেই এসময় চোখে পড়বে এসব বাহারি ফুল।
অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে আমাদের চিরচেনা এসব ফুলেল বৃক্ষরাজি বহু আগেই শহর থেকে নির্বাসিত হয়েছে। তাই গ্রীষ্মের এসব ফুল সম্পর্কে  বর্তমান প্রজন্মের তেমন  ধারণা নেই বললেই চলে।

কৃষ্ণচূড়া

কৃষ্ণচূড়া গ্রীষ্মের অতি পরিচিত একটি ফুল। বাংলা কাব্য, সাহিত্য, সংগীত ও বিভিন্ন উপমায় কৃষ্ণচূড়া ফুলের কথা ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে। শোভাবর্ধণকারী এ বৃক্ষটি গ্রামের পাশাপাশি এখনো তার নড়বড়ে অস্থিত্ব নিয়ে কোনো রকমে টিকে আছে শহরের পথে প্রান্তরে। আমাদের দেশে দুই ধরনের কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটতে দেখা যায়। একটি আগুনের মতো উজ্জ্বল লাল অন্যটি লাল হলদেটে। তবে লাল কৃষ্ণচূড়ার প্রাচুর্যতাই বেশি চোখে পড়ে। লাল হলদেটে রংয়ের কৃষ্ণচূড়া বর্তমানে বেশ বিরল।
লাল হলদেটে ফুলের কৃষ্ণচূড়াকে অনেকে রাধাচূড়া বলে থাকে। রাধাচূড়া ফুলে মূলত লাল ও হলুদের সংমিশ্রণ দেখা যায়। তবে কনকচূড়া ফুল সম্পূর্ণ রূপে হলুদ হয়ে থাকে।  ইদানিং  রাস্তার পাশে কনকচূড়া ফুল বেশ  চোখে পড়ে।
কৃষ্ণচূড়ার আদি নিবাস পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার, রাধাচূড়ার জন্ম ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর কনকচূড়ার জন্মস্থান শ্রীলংকা বা অস্ট্রেলিয়া। ভীনদেশি এ ফুলেল বৃক্ষগুলো আমাদের দেশে এসে নতুন নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। ধারণা করা হয় হিন্দু পুরাণের রাধা ও কৃষ্ণের নামানুসারে বৃক্ষ দুটির নাম হয়েছে কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া।

তবে কনকচূড়ার নাম হাল আমলে বৃক্ষপ্রেমীরা দিয়েছেন বলে অনুমেয়। গ্রীষ্মে যখন কৃষ্ণচূড়া ফোটে এর রূপে মুগ্ধ হয়ে ব্যস্ত পথচারীও থমকে তাকায় কিছু সময়ের জন্য।

জারুল

গ্রীষ্মের দাবদাহে চোখ ধাঁধাঁনো বেগুনি রংয়ের বিচ্ছুরণ নিয়ে প্রকৃতিতে নিজের আগমনের কথা জানান দেয় জারুল ফুল। গ্রীষ্মের ফুল হিসেবে জারুল অতুলনীয়। বর্তমানে শহরে জারুল গাছ খুবই বিরল। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনো জারুল গাছের আধিক্য লক্ষ করা যায়। চমৎকার বেগুনি রংয়ে রাঙ্গানো এ জারুল ফুল আমাদের মনের গহীনে জাগ্রত করে এক অন্য রকম ভাললাগা।
সোনালু

হলুদে ছাওয়া ঝুমকার মতো ঝুলে থাকা সোনালু ফুল যে কারো মন ছুঁয়ে যাবে। সোনালু গাছ আমাদের দেশে ঔষধি গাছ হিসেবেই বেশি পরিচিত। গ্রামাঞ্চলে এ গাছকে অনেকে বানর লাঠি গাছও বলে থাকে। সোনালু গাছের ফল ঠান্ডা ও কাশি উপশমের জন্য বেশ উপকারী।
আমাদের দেশে সোনালু গাছ আগের মতো তেমন একটা চোখে পড়েনা। তবে গ্রামে এখনো কিছু সোনালু গাছ দেখতে পাওয়া যায়। ঝুমকা ঝুমকা সোনালু ফুলের রূপ সৌন্দর্য সবাইকে নিয়ে যায় ভাবনার জগতে। গ্রীষ্মের বাতাসে হলুদ সোনালু ফুলের দোলা প্রকৃতিতে সৃষ্টি করে এক অন্য রকম আবহ। গ্রীষ্মের ফুল হিসেবে সোনালু ফুল এক কথায় অনন্য। প্রতি বছর গ্রীষ্মে হলুদ পরী হয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয় সোনালু ফুল।
হিজল
 
"এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে— সবচেয়ে সুন্দর করুণ:
সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বথ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ"
— জীবনানন্দ দাশ
— 

ঐতিহ্যবাহী গাছের মধ্যে হিজল গাছ একটি। এ গাছটি আমাদের প্রকৃতি থেকে দিন দিন হারিয়েই যাচ্ছে। হিজল গাছ পুকুর, খাল ও জলাশয়ের ধারে বেশি জন্মায়। হিজল গাছের সবচেয়ে বেশি ভাললাগার দিকটি হচ্ছে এর চমৎকার ফুল।
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে হিজল গাছে ফুল ফুটতে শুরু করে। রক্ত রাঙ্গা হিজল ফুলের লহরি আর মাতাল ঘ্রাণ সবাইকে বিমোহিত করে তোলে। ছোট আকৃতির রক্ত রাঙ্গা হিজল ফুল গাছের নিচে ঝরে পড়ে সৃষ্টি করে এক দৃষ্টি নন্দন পুষ্প শয্যা।
চিরায়ত বাংলার হিজল ফুলের প্রেমে পড়ে অনেক কবি -সাহিত্যিক রচনা করেছেন বহু গল্প-কবিতা। তাই বাঙ্গালী হৃদয়ে হিজল ফুলের আবেদন হয়তো কখনো ফুরাবে না।

গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে চারদিক যখন খাঁখাঁ করছে, প্রচণ্ড গরমে জীবন যখন ওষ্ঠাগত, শরীর থেকে ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে— এমন পরিস্থিতিতে তখন আপনি কোনো বাহনে কিংবা পায়ে হাঁটার সময় রাস্তার পাশে প্রকৃতিতে দেখতে পাবেন ব্যতিক্রমী এক দৃশ্য। শহর কিংবা গ্রামের গাছে গাছে যেন মেলা বসেছে বাহারি ফুলের।
  

.রক্তরাগ\স্কারলেট কর্ডিয়া 

 "..লাল রঙে রঞ্জিত ওগো রক্তরাগ ,
তোমায় দিয়ে সাজাব আমার কুসুমবাগ "।


ফুলের নাম- রক্তরাগ, স্কারলেট কর্ডিয়া
বৈজ্ঞানিক নাম- Cordia sebestena
পরিবার- Boraginaceae
অন্যান্য নাম- siricote/kopté (Mayan), Geiger Tree, scarlet cordia



স্কারলেট কর্ডিয়া-এর আদি আবাস কিউবা ও পেরু হলেও এই কিউবিয়ান সুন্দরী  আমাদের আপন হয়ে গেছে । এর বাংলা নাম হল ....রক্তরাগ !! অসাধারণ রঙ আর রূপের সঙ্গে এর রক্তরাগ নামটি বেশ মানানসই । গাছের শাখায় গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের শোভা এক পলকেই সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ফুলের উজ্জ্বল কমলা রঙ আর পাতার টিয়ে সবুজ রঙে কর্ডিয়ার অপূর্ব সাজ বেশ নজরকাড়া। গাছে ফুল থাকে প্রায় সারা বছরই, তবে শীত থেকে বসন্তে বেশি।




        মম    হৃদয়রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া,
                   অয়ি    সন্ধ্যাস্বপনবিহারী।
          তব    অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া--
                   তুমি    আমারি, তুমি আমারি,
                   মম    বিজনজীবনবিহারী॥
মম      মোহের স্বপন-অঞ্জন তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে,
                   অয়ি    মুগ্ধনয়নবিহারী
মম      সঙ্গীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে--
                   তুমি    আমারি, তুমি আমারি,
                   মম    জীবনমরণবিহারী॥

তুমি    সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
                   মম    শূন্যগগনবিহারী।
আমি    আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা--
                   তুমি    আমারি, তুমি আমারি,
                   মম     অসীমগগনবিহারী॥

 সুন্দরীর কথা :- আঠার শতকে ওলন্দাজরা এ গাছ ভারতে নিয়ে আসে।
১)গাছ ছোটখাটো, ৫ থেকে ৮ মিটার উঁচু, চিরসবুজ, কখনো গুল্ম আকারের।
২)পাতা একক, ১০ থেকে ১৮ সেমি লম্বা, ডিম্বাকার বা উপবৃত্তাকার।
৪) ডালের আগায় গুচ্ছবদ্ধ ফুল ফোটে প্রায় সারা বছর।
৫) ফুল ৩ থেকে ৫ সেমি লম্বা, পাপড়ি সংখ্যা ৬।
৬) ফল ডিম্বাকার, শাঁসাল, প্রায় ৪ সেমি লম্বা, বৃতিযুক্ত। বীজ আঠাল শাঁসে জড়ানো।
৭) শুষ্ক অঞ্চলে ভালো বাড়ে। বীজ, কলম ও দাবাকলমে চাষ।


কদম ফুল 

 

"বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
 আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।।
 মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে
 এই যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান।।
 আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল
 রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।
 এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে
 তব বিস্মৃতিস্রোতের প্লাবনে
 ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী
 বহি তব সম্মান।।"


জ্যাকারান্ডা 

 

জ্যাকারান্ডা দেশি গাছ নয়, জন্মস্থান ব্রাজিল। এ সুদর্শন গাছটি আমাদের বাংলায়  প্রায় ৭০-৮০ বছর আগে এলেও ততটা বিস্তার লাভ করেনি। প্রধান কারণ হিসেবে জলাবদ্ধতাকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা আমাদের জলীয় ভিজে আবহাওয়াকে এ গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা মনে করেন। জ্যাকারান্ডা মাঝারি আকৃতির পত্রমোচি বৃক্ষ। কাণ্ড মসৃণ ও হালকা ধূসর রঙের। পাতা চিরল চিরল, কারুকার্যময় ও বিন্যাস বিপ্রতীপ। গ্রীষ্মের প্রথম ভাগেই নতুন পাতা গজাতে শুরু করে।
 তার পর পরই প্রায়-পাতাহীন ডালের আগায় গুচ্ছবদ্ধ ফুল ফুটতে শুরু করে। পরিপূর্ণ প্রস্টম্ফুটিত জ্যাকারান্ডার জৌলুস সত্যিই মনোমুগ্ধকর। তা ছাড়া এ ফুল চটজলদি ঝরেও পড়ে না। অনেক দিন ধরেই এর শোভা উপভোগ করা যায়। ফুলের রঙ বেগুনি, দেখতে নলাকার, ২ ইঞ্চি লম্বা। এ গাছের কাঠ দামি ও সুগন্ধি। ভেতরের আঁশ বেগুনি ও কালো রেখায় চিত্রিত। জন্মস্থানে এই গাছের পাতা বক্ষরোগ ও ক্ষতের চিকিৎসায় কাজে লাগে। বাকলের নির্যাস থেকে তৈরি হয় বিভিন্ন রোগের মহৌষধ। দেশের যেসব স্থানে বন্যার পানি জমে না, সেসব স্থানে এবং পাহাড়ি এলাকায় এই গাছ বেশি পরিমাণে রোপণ করা প্রয়োজন।  আমাদের জাতীয় সড়ক পথের ধারে এক সারি জ্যাকারান্ডা রোপণ করে তার প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করা যেতে পারে। 

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু শহরে পরিকল্পিতভাবে জ্যাকারান্ডা লাগানো হয়েছে। সেখানে জ্যাকারান্ডার নীলচে-বেগুনি রঙের পাশে সিলভার ওকের হলুদ-সোনালি বর্ণ বৈচিত্র্য তৈরি করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রশাসনিক রাজধানী প্রিটোরিয়া জ্যাকারান্ডার শহর নামে পরিচিত। অবশ্য বাণিজ্যিক রাজধানী কেপটাউনেও অসংখ্য গাছ রয়েছে। জ্যাকারান্ডা অপেক্ষাকৃত কম শীতের দেশগুলোতে ভালো জন্মে। এ গাছ যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি ও জাম্বিয়ায় বেশ সহজলভ্য। আলঙ্করিক বৃক্ষ হিসেবে বর্তমানে সারা বিশ্বেই এটি বেশ জনপ্রিয়।

ফুল্লরা( ক্রেব বা ফুরুস ফুল)

কয়েক দশক ধরে চীন থেকে বহু জিনিষ এসেছে আমাদের দেশে ,প্রায় সব কিছুই অত্যন্ত নিম্নমানের। এখন অবস্থাটা এমন হয়েছে,চীনের জিনিস তাড়াতে পারলে বাঁচি,.......... কিন্তু আর মাঝেই কয়েক দশক আগে চীন থেকে আসা একটা জিনিস আমার পরম প্রিয় ,আমার ধারণা আমার মতো অনেকেরই প্রিয় জিনিসটি হলো  ক্রেব বা ফুরুস ফুল।
আগেই বলেছি এই ফুল আমাদের দেশি নয়। পোশাকি নাম ক্রেব বা ফুরুস। কিন্তু আমাদের দেশে ভুল করে এদের চেরি ফুল নামে ডাকা হয়। আদতে আমাদের দেশে চেরি ফুলের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ চেরি ফুল ফোটানোর চেষ্টা করেছেন। খুব একটা সফল হননি। বর্ণিত ফুলটি  চীনের প্রজাতি। আমাদের দেশে এসেছে মাত্র কয়েক দশক আগে। বর্ণবৈচিত্র্য, দীর্ঘ প্রস্ফুটন প্রক্রিয়া ও প্রাচুর্যের কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।  বর্ষার প্রকৃতিকে মাতিয়ে রাখতে এর কোনো জুড়ি নেই। এ গাছ প্রায় চার মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গাছটি বেশ শক্ত এবং  ডালপালায় ভরা। পাতার বিন্যাস ঘূর্ণিত এবং দেখতে ডিম্বাকৃতির। সাধারণত সাড়ে তিন থেকে ছয় সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। বর্ষাকালে ডালের আগায় ছোট ছোট ফুলের অনেক বড় বড় থোকা হয়। একেকটি ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা ও শাখায়িত। এই ফুলের অনেক রঙ_ সাদা, গোলাপি, লাল, বেগুনি।
ফুল তিন সেন্টিমিটার চওড়া এবং কোঁকড়ানো পাপড়ির সংখ্যা ছয়টি। এই ফুল গন্ধহীন হলেও সব রঙ নিয়ে চমৎকার বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা যায়। বিদেশি হলেও আমাদের দেশে এরা বেশ মানানসই,এখন আর একে বিদেশি বলে মানি হয়না। আমার মেয়ে তিতলি আর নাম দিয়েছে ফুল্লরা।
 

রূপসী রুদ্রপলাশ 

 বসন্তের শুরুতে বৃক্ষচূড়ায় রাশি রাশি রুদ্রপলাশের ফুল দেখে মানুষ অভিভূত হয়ে পড়ে। এর আদিবাস পশ্চিম আফ্রিকা হলেও আমাদের দেশে এর পরিচিতি আছে। দূর থেকে দেখতে থোকা থোকা টিউলিপ সদৃশ বলে এর ইংরাজি নাম আফ্রিকান টিউলিপ। এই ফুলের কুঁড়িতে পলাশ (Butea monosperma)এর আদল আছে, রংটাও তার মতো এবং স্বভাবে যেন রুদ্র বা উগ্র তাই হয়তো  একে রুদ্রপলাশ নামে ডাকা  সার্থক হয়েছে । উপযুক্ত আবহাওয়ায় হাওয়াই দ্বীপে সারা বছর ধরেই ফুটতে থাকে এই ফুল যার আরো কিছু অর্থবহ নাম আছে। 
 গাছের চূড়ায় অগ্নি শিখার মতো মনে হয় বলে একে ফ্লেমিং ট্রি বা ফ্লেম অফ দি ফরেস্ট বলা হয়, যা কৃষ্ণচূড়া  বা আরো কিছু গাছের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। এর একটি নাম ‘ফাউনটেন ট্রি’। এর ফুলের কুঁড়ির ভেতরে থাকে জল। বয়স তিন চার বছর হলেই ফুল ধরে গাছে, আর তখন সেগুলি বেশ নিচু থাকে বলে আফ্রিকার ছেলেমেয়েরা এই কুঁড়ি নিয়ে খেলার সুযোগ পায়। আগায় সামান্য ছিদ্র করে টিপে দিলে তীরবেগে বেরিয়ে আসে জল  যাকে তারা ব্যবহার খেলনা ‘ওয়াটার-গান” হিসেবে। এ ছাড়াও যখন ফুল ফোটে তখন সেগুলি জোড়া লাগা পাপড়ির কারণে বৃষ্টি বা শিশিরের জল ধারণ করে, যে জল ‘ফাউন্টেন’ থেকে পান করে পাখিরা।

  রুদ্রপলাশ পাখিদের জন্যে এটি একটি অনুপম আস্তানা। কিছু পাখি এর বীজ খায় যা দেখতে মনে হয় স্বচ্ছ কাগজের মধ্যে আটকানো একটি হার্ট। এই হার্ট দেখে মনে হয় কেউ যেন মার্কার পেন দিয়ে শেপটা যত্ন করে এঁকে দিয়েছে। এর নৌকোর মতো সিডপডের খোলে ৫০০ র মতো বীজ হয় যা হালকা হবার কারণে উড়ে যেতে পারে দূরে যেখান থেকে আবার নতুন গাছের জন্ম হয়। তবে কোনো কারণে এই গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হলে ‘সাকার রুট’ থেকে আবার নতুন গাছ তৈরি হতে পারে।
এর কাঠ খুব নরম। পোর্টো রিকোর একটি স্বাস্থ্যবান গাছ বছরে দুই ইঞ্চি করে বেড়ে যেতে পারে। আর এতো দ্রুত বেড়ে যায় বলে কাঠের ঘন হবার সুযোগ থাকে কম। কাঠ নরম হবার কারণে এর কাণ্ডের চাক খোদাই করে তৈরি হয় আদিবাসীদের বাদ্যযন্ত্রের খোল যা মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের দোকানেও পাওয়া যায়। গাছের ওপরের দিকের ডালে শাদা রঙের কিছু দাগ দেখা যায় যেগুলি লেন্টিসেল, এক ধরণের ছিদ্র যার ভেতর দিয়ে গাছের শ্বাস নেবার বন্দোবস্ত থাকে। এ গাছের পাতাগুলি যৌগিক। সংখ্যায় ৭ থেকে ১৭ যাই হোক কিনারের দিকে একটি পাতা অতিরিক্ত থাকবেই যে কারণে সব সময় এর পাতা হয় বিজোড় সংখ্যার। পাতার গোড়ায় ছোট ছোট দুচারটে গ্রন্থিও দেখা যায় যা একটু উঁচু হয়ে থাকে।
রুদ্রপলাশের নরম শরীরে বারবেট বা কাঠঠোকরা জাতীয় পাখি গর্ত করে বাসা তৈরি করে, বাচ্চা ওঠায়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, যেখানটায় গর্ত করে ঠিক তার নিচে বা আশেপাশেও কাঠের কোনো টুকরো পড়ে থাকতে দেখা যায় না। নিরাপত্তার কারণে, যাতে কোনো হিংস্র প্রাণি নীড়ের হদিস না পায় সেজন্যে কাঠের ছোট ছোট টুকরোগুলো তারা অনেক দূরে নিয়ে ফেলে দেয়। কিছু পাখি এই টুকরোগুলো খেয়েও ফেলে যা দূরে গিয়ে উগলে দেয়। বারবেটের জন্যে বাসা বানানো কোনো ব্যাপারই নয়, এক বাসা সে কখনো দুইবার ব্যবহার করে না, এসব পরিত্যক্ত বাসা তখন যেসব পাখি গর্ত করে বাসা তৈরি করতে পারে না তারাই ব্যবহার করে, যার মধ্যে রয়েছে কিছু টিয়া জাতীয় পাখি।
এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম স্প্যাথোডিয়া ক্যাম্পানিউলেটা (Spathodea Campanulata). এর ফুলের বৃতি বা ক্যালিক্স-এর আকৃতি কিছুটা বাঁকা স্পেড বা কোদালের মতো বলে জেনাস-এর এই নাম। আর ঘন্টা বা বাটির মতো বলে ক্যাম্পানিউলেটা। এই গণ-এ মাত্র একটি মাত্র উদ্ভিদই নজরে আসে। অস্ট্রেলিয়াতে হলুদ বা স্বর্ণাভ ফুলের একটি কাল্টিভার বা আবাদিত গাছ উদ্ভাবিত হয়েছে যাকে Spathodea companulata ‘Aurea’ নাম দেয়া হয়েছে।
আফ্রিকার গোল্ডকোস্টেই এই গাছ প্রথম চোখে পড়ে প্রকৃতিবিদদের। ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সুদান,‌ জাম্বিয়া ইত্যাদি আফ্রিকান দেশের নেটিভ গাছ হলেও ন্যাচারালাইজড্‌ বা পরিবেশানুগ হয়েছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপোর, আমেরিকার ফ্লোরিডা, হাওয়াই এবং অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও বেশ কিছু দেশে। হাওয়াই এবং অস্ট্রেলিয়াতে এদের উইড বা স্লিপার উইড (Sleeper Weed) হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ‘স্লিপার উইড’ বলতে বোঝায় সেই সব গাছ যা সুপ্ত অবস্থায় থাকে অনেক বছর তারপর বন্যা ক্ষরা অগ্নিকাণ্ড প্লাবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে অকস্মাৎ আত্মপ্রকাশ করে। অস্ট্রেলিয়ান উইডস কমিটি একে নজরে রাখছে।
এই গাছ কিছু শহরের রাস্তার ধারে বা বাগানে লাগানো হয়েছে সিঙ্গাপোর ফ্লোরিডা ইত্যাদি অঞ্চলে। বিশ ত্রিশ বছর পর প্রায়ই রোগগ্রস্ত হতে দেখা যায় এই গাছকে, ভেতরটা ফাঁপা হয়ে যায় এবং ডালপালা ঝড়ে ভেঙে পড়ে। এর শেকড়ও ভূমির উপরিভাগ দিয়ে ছড়িয়ে পড়তে চায়, এসব কারণে এদের সরাসরি কোনো বিল্ডিং বা ফুটপাথের পাশে লাগানো বিপজ্জনক। তবু ভারত-বাংলাদেশে এই গাছ তো আগ্রাসী নয়, নির্মল সৌন্দর্যের জন্যে কিছু রুদ্রপলাশ গাছ পার্কে বাগানে থাকলে কোনো ক্ষতি নেই, বরং এখানে তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে আমাদের শিল্প-মানসে সৌন্দর্য বিকিরণ করে।
তথ্যসুত্র ও ফটো -গুগল