মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১৬

ফুলের কথা

ফুলের প্রতি কোনোরূপ আকর্ষণ নেই, ধারণা করি পৃথিবীতে এমন রুক্ষ-শুষ্ক মানুষ খুব কমই আছে। বরং নেই বললেই চলে। চার বছরের শিশু থেকে ৮০  বছরের বৃদ্ধ, কমবেশি সবার মধ্যেই ফুলের প্রতি আকর্ষণ আছে। ফুলের সৌন্দর্য আর সৌরভের কাছে পরাস্ত হয়নি, এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল।
ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক। মানুষের সৌন্দর্যপ্রেম সহজাত। সহজাত সৌন্দর্যপ্রেম থেকেই সৌন্দর্যের প্রতীক ফুলের প্রতি মানুষের আকর্ষণ। এর পাপড়ির বিন্যাস, রঙের বৈচিত্র্য ও গন্ধের মাধুর্য মানুষের মনকে ভরে তোলে স্বর্গীয় আনন্দে। ফুল পবিত্রতার প্রতীক। ফুল নিষ্পাপতার প্রতীক। কোনো মানুষের পবিত্রতা বোঝানোর জন্য আমরা বলি, ‘ফুলের মতো পবিত্র।’ শিশুকে আমরা ভালো মানুষ হতে ও নিষ্পাপ-নিষ্কলঙ্ক হতে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলি, ‘ফুলের মতো পবিত্র হও।’ শিশু নিষ্পাপ, পবিত্র। তাই শিশুকে ফুলের সঙ্গে উপমা দেয়া হয়। বলা হয়- পুষ্পশিশু।
ফুল ভালোবাসার প্রতীক। ভালোবাসার মানুষকে ফুল দেয়ার রীতি পৃথিবীতে দীর্ঘকাল থেকে চলে আসছে। বলা হয়ে থাকে, ১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার বিয়ের সময় প্রিয় মানুষকে ফুল দেয়ার রীতি প্রথম চালু হয়। সে হিসেবে ভালোবাসাবাসিতে ফুলচর্চার বয়স পৌনে ২০০ বছর।
মানব-সংস্কৃতির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ফুল। বাঙালির জীবনাচারেও ফুলের ব্যবহার বহুবিধ। ভালোবাসার অর্ঘ্য হোক অথবা ধর্মালোচনার সভা - ফুল আছে সর্বত্রই। অবোধ বালিকার বেণীতে, নবদম্পতির ফুলশয্যায়, রাজনৈতিক দলের জনসভায়, করপোরেট অফিসের টেবিলে- ফুল আছে সবখানেই ।

হিন্দু ধর্মে ফূল :-


 হিন্দু সনাতন ধর্মে পূজার্চনায় ফলের ব্যবহার অনিবার্য। প্রায় প্রতিটি দেবতার পূজাবিদি এবং মন্ত্রে পুষ্পের উল্লেখ রয়েছে। রয়েছে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের সুনির্দিষ্ট বিধি। পুষ্প সুন্দর, সুগন্ধযুক্ত। কেবল কি সেই কারণেই তার স্থান দেবতার পায়ে? নাকি আরও কোনও কারণ রয়েছে পুষ্পার্পণের পিছনে?
শাস্ত্র জানাচ্ছে—
• ফুলও ত্রিগুণসম্পন্ন। এদের মধ্যেও সত্ব, তম ও রজ-ভাদ রয়েছে। এই বিভাজন তাদের বর্ণ, গন্ধ এবং উৎসের নিরিখে কৃত।
• সত্ত্বগুণসম্পন্ন ফুল প্রতিদিনের পূজায় ব্যবহার্য। তমগুণ সম্পন্ন পুষ্প বিশেষ পূজার জন্য।
• সত্ত্বগুণস্পন্ন ফুলের মধ্যে রয়েছে, অর্ক, দ্রোণ, জুঁই, শ্বেতপদ্ম ইত্যাদি।
• রজগুণস্পন্ন ফুলের উদাহরণ রক্তপদ্ম, কল্কে ফুল।
• তমগুণসম্পন্ন ফুল চিনে জবা, কেতকী ইত্যাদি।
• মনে করা হয়, প্রতিটি ফুলের বিশেষ বিশেষ শক্তিকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা রয়েছে।
• সেই ক্ষমতা অনুযায়ী তাদের জন্য নির্দিষ্ট দেবতাও রয়েছেন। যেমন, সাদা ধুতুরা শিবের জন্য নির্দিষ্ট।
• ফুলের সঙ্গে বিল্বপত্রের প্রয়োগও শাস্ত্রানুগ। বিল্বপত্র একই রকম ভাবে শক্তিকে আকর্ষণ করে।
• ফুল ও বেলপাতার যোগ সম্ভবত এক প্রাচীন জৈবরসায়ণের সূত্রকে ব্যক্ত করে।
• তুলসি পাতার ব্যবহারও একই জৈবরাসায়নিক ভাবনার ফল।

পবিত্র কোরআনে ফুল:-
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে নানা প্রসঙ্গে ফুলের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা- ‘আমি এদের বিভিন্ন ধরনের লোককে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের ফুলস্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, তুমি সেসব বস্তুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করো না। তোমার পালনকর্তার দেয়া রিজিক উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।’ (সূরা ত্বহা : ১৩১)। এখানে ‘জীবনের ফুল’ (জাহরাতুল-হায়াত) বাক্যাংশে ‘ফুল’ শব্দটি সৌন্দর্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আরেক সূরায় এরশাদ হয়েছে, ‘যেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে, তখন সেটি গোলাপ বর্ণে রঞ্জিত চামড়ার মতো হয়ে যাবে।’ (সূরা আর-রাহমান : ৩৭)।


কবিতায় ফুলঃ-

কবিতা লিখেছেন, কিন্তু ফুল নিয়ে কবিতা লিখেননি, ফুল দিয়ে উপমা দেননি, এমনটা বিরল। সব কবিই কমবেশি ফুল নিয়ে কবিতা লিখেছেন, উপমায় ফুলের ব্যবহার করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত ফুল নিয়ে কবিরা কত শত-সহস্র কবিতা লিখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।বস্তুত  বাংলা ভাষায় ফুল নিয়ে যতো  কবিতা লেখা হয়েছে তার কথা লেখার সামর্থ আমার নেই।   বিশ্ব কবি  রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,জীবনানন্দ থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক কবিরা পর্যন্ত সব কবি ও লেখকদের লেখায় ফুলের কথা বর্তমান , কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন-
‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!
বাজারে বিকায় ফল ত-ুল
সে শুধু মিটায় দেহের ক্ষুধা,
হৃদয়-প্রাণের ক্ষুধা নাশে ফুল
দুনিয়ার মাঝে সেই তো সুধা!’
প্রচলিত আছে, কবিতাটি নাকি কোনো এক হাদিসের অনুবাদ। প্রচলিত কথাটি ভুল। এ মর্মে কোনো হাদিস আছে বলে আমাদের জানা নেই।
কবি জসীমউদ্দীন ‘হলুদ বরণী’ কবিতায় লিখেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’ কবিতাংশটুকু প্রবাদে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদ ফুল নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন। তার কবিতাগুলো থেকে একটি উদাহরণ,
‘দীঘির কথায় উঠলো হেসে ফুলপাখিরা সব
কাব্য হবে কাব্য হবে জুড়লো কলরব
কী আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই
পাখির কাছে ফুলের কাছে মনের কথা কই।’
ফুল নিয়ে রচিত এ ধরনের হাজারও উদাহরণ দিতে চাইলেও দেয়া সম্ভব।


সঙ্গীতে ফুলের ব্যবহার:-
কবিতার মতো গানেও ফুলের ব্যবহার অধিক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ , কবি কাজী নজরুল ইসলাম গানে ফুলের ব্যবহার সম্ভবত আর সব গীতিকারের চেয়ে বেশি করেছেন। উপমহাদেশে পাওয়া যায়, এমন প্রায় সব ফুলের কথাই তার গানে কোনো না কোনোভাবে উল্লেখ করেছেন। এমনকি যেসব ফুলের প্রতি মানুষের কোনোরূপ আগ্রহ নেই, নজরুল সেসব নিয়েও অনবদ্য সঙ্গীত রচনা করেছেন। যথা- ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ গানে এলাচির ফুল-
‘… তব কবরী মূলে, নব এলাচীর ফুল
দুলে কুসুম বিলাসিনী।’
অন্য একটি গানে বেলের ফুল-
‘বেল ফুল এনে দাও চাই না বকুল।
চাই না হেনা আনো আমের মুকুল।’
ফুলের নামে নামকরণ
ফুল মানুষ পছন্দ করে। একারণেই হয়তো মানুষ প্রিয় সন্তানের নাম ফুলের নামে রাখে। মেয়েদের নাম নিম্নোক্ত ফুলগুলোর নামে রাখতে খুব দেখা যায়, শিউলি, চামেলি, শেফালি, কামিনী, মালতী, শিরীন, নার্গিস, কনকচাঁপা, অপরাজিতা, যূথী, বকুল, জুঁই, টিউলিপ, হাসনাহেনা, ডালিয়া, মলি্লকা, হেনা, ঝুমকা, জবা, পারুল, মহুয়া, চম্পা, বকুল, কেয়া, টগর, গোলাপ, বকুল, পিয়াল, গোলাপ, শিমুল, পলাশ ইত্যাদি ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন