শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৬



দীপাবলির আগের দিন ভূতচতু্র্দশী,এই দিন  বাঙালি গৃহস্থবাড়িতে ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয় ,  সঙ্গে নিয়ম রয়েছে, খেতে হয় ১৪ রকম শাক-ও৷ভূতচতু্র্দশীতে, ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে এদিন দুপুরে ভাতের সঙ্গে খেতে হয় ১৪ রকম শাকভাজা। কথিত আছে, অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে এবং অতৃপ্ত আত্মাদের তুষ্ট করতে এই দিনে ১৪ শাক খাওয়া হয় এবং সন্ধ্যায় ১৪ টি প্রদীপ জ্বালানো হয়।
ঘোর অমাবস্যায় অন্ধকার দূর করতেই দীপ জ্বালানোর রেওয়াজ। আর ১৪টি শাক খাওয়ার নিয়মটি এসেছে প্রধানত স্বাস্থ্যরক্ষার্থে। কারণ ঠান্ডার আমেজ এসে যায় এই সময়। মরসুম বদলের সময় প্রধানত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতেই ১৪টি শাক খাওয়া দরকার। অন্তত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাতে বিষয়টি তাই দাঁড়ায়। এই শাকগুলি হল যথাক্রমে— ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, , নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা এবং শুষণী।শরীর ভালো রাখতে গ্রিন ভেজিটেবিলস এর বিকল্প যে কিছু হতে পারে না, তা তো সকলেই জানেন৷ বিশেষত আয়ুর্বেদ এবং কবিরাজি শাস্ত্রে এই শাকগুলির গুণ অসীম। পঞ্জিকায় নির্দেশিত এই চোদ্দ শাক, বা আয়ুর্বেদ মতে প্রাচীন বাংলায় চোদ্দো শাকগুলি ছিল পালং শাক, লাল শাক, সুষণি শাক, পাট শাক, ধনে শাক, পুঁই শাক, কুমড়ো শাক, গিমে শাক, মূলো শাক, কলমি শাক, সরষে শাক, নোটে শাক, মেথি শাক, লাউ শাক অথবা হিঞ্চে শাক। বিধিমতো খাওয়া উচিত। তবে তরুণ  প্রজন্মের একটা বড় অংশ এসব নিয়মের ধার ধারে না, তা বলাই বাহুল্য।
ওল :-ভেষজ হিসেবে উৎকৃষ্ট ওল। এটি অত্যন্ত উপকারী একটি ভেষজ খাবার। এটি অর্শ্বরোগ সারায় বলে সংস্কৃত ভাষায় ওলকে অর্শ্বঘ্ন বলা হয়। এটি খিদে বাড়ায়, রুচিকারক, পিত্ত ও কোষ্ঠবদ্ধতা দূর করে ও রক্ত পরিষ্কারক। ওল কৃমি, পেটের পীড়া, পেটের বায়ু ও কফ নাশ করে, পিলের অসুখ ছাড়াও অনেক রোগের মহাষৌধ দিসেবে কাজ করে ওল।


বেতশাকঃ- আমাদের বাসভূমির আশেপাশে জন্মায় বলে এই বেতো শাকের আরেক নাম বাস্তক। এর গাছ হয় ছোট, গাছের পাতা অনেকটা তুলসী পাতার মতো, কিন্তু পাতাগুলোর ধার বেশ ঢেউ খেলানো। বোটানিক্যাল নাম- Chenopodium album Linn. এই গাছ সাধারণত জ্বরনাশক। লাল রংয়ের পাতাওয়ালা এক ধরনের বেতো পাওয়া যায়। চন্দন বেতো নামে আর এক ধরনের বেতো শাক পাওয়া যায়। বেতো শাক বায়ু, পিত্ত ও কফনাশক এবং অগ্নিবল বৃদ্ধিকারক। এটি ক্ষারধর্মী। এর মধ্যে কৃমিনাশক শক্তি রয়েছে।
 পুষ্টিকর শাক হিসেবে সর্ষে শাকও কিন্তু বেশ পরিচিত। এতে আছে ভিটামিন সি, কে, এ, সালফার। এতে থাকা ভিটামিন সিতে আছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা দেহকে ভাইরাল অসুখ থেকে রক্ষা করে। ভিটামিন এ ভালো রাখে দৃষ্টিশক্তি আর ভিটামিন কে হাড় এবং মস্তিষ্ককে রাখে সচল। সালফার দেহে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থ বের করতে সাহায্য করে। এটি দেহে হার্ট অ্যাটাক, আর্থ্রাইটিস ও ক্রনিক রোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনে। এর ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

সর্ষে শাকঃ-এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত সর্ষে শাক খায় তাদের বিভিন্ন রকম ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। এটি রক্তে কোলস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে আনে। সেই সঙ্গে কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতেও কার্যকর। এটি হজম শক্তি বাড়াতে সরাসরি কাজ করে। এই শাক ত্বক ও চুল ভালো রাখে এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে। সর্ষে শাক গর্ভবতী মায়েদের সুস্থ শিশু জন্মদানের সম্ভাবনা বাড়ায়।

 কালাকাসুন্দে :-
কালা কাসুন্দেঃ বর্ষজীবী গাছ, এক মানুষ সমান উচুঁ হয়। ঝাড়দার গাছ, বর্ষার প্রারম্ভে বীজ থেকে গাছ জন্মায়। এর পাতা সবুজ, এক একটা লম্বা বোটায় ৫-৬ জোড়া পাতা, চটকালে কটুগন্ধ বের হয়। ফুলের রং লালচে হলদে। ফলগুলি বরবটির মত গুটি হয়, প্রত্যেক গুটিতে ২০-২৫টি বীজ পাওয়া যায়। এই গাছের পাতার শির এবং গাছের উপরের অংশটা একটু বেগুনি রং এর হয়। একে কালা কাসুন্দে  বলে। এই গাছের পাতা, ফুল, মূল অর্থ্যাৎ সমগ্র গাছ ঔষধার্থে ব্যবহার হয়।

 

যেসব রোগে কালা কাসুন্দে ব্যবহার হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য-অরুচী, গলাভাঙ্গা, গলা-বুক জ্বালা, পাতলা পায়খানা, হুপিং কাশি,মূর্ছা, ঘুসঘুসে জ্বর, হাঁপানী এবং শরীরের চাকা চাকা ফুলে উঠা এলার্জি।
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে পাতা সিদ্ধকরে অল্প পরিমাণ খেতে হয় অথবা পাতা এবং ফুলের রস ১-২ চা চামচ পরিমাণ খেতে হয়। আবার অনেক সময় মূলের ছাল বেঁটে খেতে হয়। 

নিমপাতা :-
জেনে নিন নিমপাতার স্বাস্থ্য উপকারিতা
ভেষজ উদ্ভিদের নামের তালিকায় সবসময় নিমপাতা শীর্ষে থাকে। অনেকে বলে থাকেন সর্বরোগের ঔষধ হল এই নিমপাতা। শতশত বছর ধরে আয়ুর্বেদিক ঐতিহ্যে নিমপাতার হরেক রকমের ব্যবহার হয়ে আসছে। নিমপাতার বিভিন্ন ধরণের কার্যকারিতা নিম্নে আলোচনা করা হল-
১. নিম আমাদের অতি পরিচিত একটি গাছ। এটি আয়ুর্বেদের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। নিমপাতা হতে তৈরিকৃত ঔষধ চুল ও ত্বকের যত্নে ব্যবহার করা হয়।
২. নিমের পাতায় অ্যান্টি-ফুঙ্গাল ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান রয়েছে। যা চুলের খুশকি দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
৩. এটি চুলকানি, শুষ্কতা ও মানসিক অস্থিরতা দূর করে। যার ফলে চুল দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
৪. নিমপাতা দিয়ে তৈরিকৃত পেস্ট চুল ও মাথার স্ক্যাল্পের জন্য কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে।
৫. এটি ত্বকের জ্বালা দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
৬. নিমের ডি-টক্সিফাইং বৈশিষ্ট্যের জন্য ত্বকের রোগ চিকিত্সায় সকল আয়ুর্বেদিক ফর্মুলেশনে এর উল্লেখ করা হয়।
৭. ব্রণ বৃদ্ধি করে যে সকল ব্যাকটেরিয়া নিমপাতা তা দূর করে।
৮. নিমের তেল ও নিমের পাতায় চমৎকার উপাদান রয়েছে যা ত্বকের জন্য অনেক উপকারী। তেল শুষ্ক ত্বক, মানসিক স্থিরতা ও চুলকানি, লালভাব এবং জ্বালা দূর করে।
৯. আলসারের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ বিরোধিতা এবং অনাক্রম্যতা উন্নতি করতে সাহায্য করে।
১০. নিমপাতার অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য কোন সংক্রমণ বা পচনশীল অবস্থার ক্ষত আরোগ্য করতে সাহায্য করে।
১১. ব্রণের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে নিম অসাধারণ সাহায্য করে।
১২. এটা কাউর এবং ছোটখাট চামড়া সংক্রমণের মত ত্বকের রোগের জন্য বিশেষ উপকারী।
১৩. এতে গ্যাস্ট্রো প্রতিরক্ষামূলক উপাদান রয়েছে, যা আলসার নিরাময়ে কার্যকর।
১৪. এতে উচ্চ পর্যায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমূহ রয়েছে যা পরিবেশগত ক্ষতি এবং সুপরিণতি থেকে ত্বক রক্ষা করতে সাহায্য করে।
১৫. নিমের তেলে বিভিন্ন ফ্যাটি এসিড এবং ভিটামিন ‘ই’ রয়েছে। এটি ত্বক কোষের পুনর্যৌবন এবং স্থিতিস্থাপকতা পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে।
১৬. এটি একটি প্রদীপ্ত চামড়া ও চামড়ার স্বনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
১৭. নিমপাতা ছত্রাকের সংক্রমণ দূর করতে পারে।–সূত্র: টাইম্‌স অফ ইন্ডিয়া।
জয়ন্তী শাক :-জয়ন্তী মাঝারি আকারের বৃক্ষ। হুবহু ধইঞ্চার মত দেখতে ফুল, পাতা, ফল সব কিছুই। এর চারা গাছ দেখে অনেক অভিজ্ঞও ধইঞ্চা বলে ভুল করতে পারেন। উচ্চতা ৮ মিটার পর্যন্ত হয়। কাণ্ডে খুব অল্প ব্যবধানে ঘন ঘন ডাল বের হয়। দ্রুত বর্ধনশীল ক্ষণজীবী বৃক্ষ এটি। বাঁচে প্রায় তিন চার বছর। থোকা থোকা সনালী ফুলের বাহার খুব মনোমুগ্ধকর। ফুলের আকার এক সেন্টিমিটার প্রায়। পাপড়ির ওপরের ভাগ হলুদ রঙের, নিচের দিক বাদামি রঙের ওপর ছোট ছোট কালো অসংখ্য ছিটেফোঁটা থাকে। কুঁড়ি অবস্থায় শুধু কালো ছিটেফোঁটা বাদামি রংটিই দেখা যায়। ফুল ফোটে শীতের শুরু হতে গরমের আগে পর্যন্ত, তবে বছর জুড়েই একটি দুটি ফুল দেখা যায়। ফল চিকন লম্বাটে, কাঁচা অবস্থায় সবুজ। শুকিয়ে গেলে বাদামি বর্ণ। দুর্গা পূজায় নবপত্রিকা তৈরিতে জয়ন্তী লাগবেই। নবপত্রিকা বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। এখানে নবপত্রিকা মানে ৯ টি উদ্ভিদ। এই নয়টি উদ্ভিদের একটি এই জয়ন্তী।
সাঞ্চে \শাঞ্চে:-





  
অবশ্য
তাতে যে খুব অমঙ্গল কিছু ঘটে, তেমনটাও নয়। তবে শরীরের কথা মাথায় রেখে এই শাক খাওয়া যেতেই পারে, কি বলেন?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন