শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার — চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,
তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,
দেহের স্বাদের কথা কয় –
বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট করে দেবে তার সাধের সময়!
চারি দিকে এখন সকাল –
রোদের নরম রঙ শিশুর গালের মতো লাল!
মাঠের ঘাসের পরে শৈশবের ঘ্রাণ –
পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান!
চারি দিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল!
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!
শরীর এলায়ে আসে এই খানে ফলন্ত ধানের মতো করে
যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায় তাহার ঠোটের চুমো ধ’রে
আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর,
চারি দিকে ছায়া — রোদ — ক্ষুদ — কুঁড়া — কার্তিকের ভিড়:
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এই খানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপাশালি ধান ভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ!
আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই — নুয়ে আছে নদীর এপারে
বিয়োবার দেরি না — রূপ ঝরে পড়ে তার –
শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে!
আজও তবুও ফুরায় নি বৎসরের নতুন বয়স,
মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ, ভাড়ারের রস!
মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়
সকালবেলা রৌদ্রে; কুঁড়িমির আজিকে সময়।
গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন্ ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া!
তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া;
ভুলে গিয়ে রাজ্য — জয় — সাম্রাজ্যের কথা
অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা;
ডেকে লব আইবুড় পাড়াগাঁর মেয়েদের সব –
মাঠের নিস্তেজ রোদের নাচ হবে –
শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।
হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে
কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;
ফলন্ত ধানের গন্ধে — রঙে তার — স্বাদে তার ভরে যাবে আমাদের সকলের দেহ;
রাগ কেহ করিবে না — আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ।
আমাদের অবসর বেশি নয — ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময়
আমাদের সকলের আগে শেষ হয়
দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ — অবসাদ –
আমাদের ডেকে লয় — তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা — অবসন্ন হাত।
তখন শস্যের গন্ধ ফুরায়ে গিয়েছে ক্ষেতে — রোদ গেছে পড়ে,
এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধরে;
তখন গিয়েছে থেমে অই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড়
হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালির
বিছানার পর;
মদের ফোঁটার শেষ হয়ে গেছে এ মাঠের মাটির ভিতর!
তখন সবুজ ঘাস হয়ে গেছে শাদা সব, হয়ে গেছে আকাশ ধবল,
চলে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদের দল!
--------------জীবনানন্দ দাশ
আকাশজুড়ে নীল মেঘের ছড়াছড়ি। প্রকৃতিতে মিষ্টি রোদের ঝিলিক। সবুজ পাতায় উপর খেলা করে সকালের সোনারোদ। নরম সকালে দূর্বাঘাসের ডগায় ফুটে ছোট ছোট শিশিরবিন্দু। দিগন্ত প্রসারিত মাঠে হলুদ ধানের জড়াজড়ি।আকাশে বাতাসে হৈমন্তী শোভা ,........... আসছেন ঋতুরাজকন্যা হেমন্ত। কবি জসিমউদ্দীন লিখেছেন-
‘সবুজ হলুদে সোহাগ ঢুলায়ে ধান ক্ষেত,
পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সাদা সঙ্কেত।
ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে,
ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়া পাখিগুলি শুয়েছে মাঠের পরে।
কৃষাণ কনের বিয়ে হবে হবে তার হলদি কোটার শাড়ি,
হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কচি রোদ রেখা-নাড়ি।’
ঝিমিয়ে থাকা লাউ গাছটা লকলকিয়ে বাড়তে থাকে। শিমগাছে সাদার ভেতর বেগুনি রঙের ফুল ফোটে। পাকা ধানের গন্ধে মৌ মৌ করে উত্তরের বাতাস। কানা বক মাছ ধরতে আসে নদীর তীরে। মাছরাঙা বসে থাকে পুকুরের গাছের ডালে। কাশফুল শরতের নিজস্ব ফুল হলেও হেমন্তে উঁচু টিলায় সাদা সাদা কাশফুল ফুটতে দেখা যায়। খালে-বিলে, হাওড়-বিলে, পুকুরে শাপলা ফুটে। গ্রাম্য কিশোর-কিশোরীরা দলবেঁধে ফুল তুলতে আসে। শরতে ফোটা শেফালি, স্থলপদ্ম হেমন্তেও রূপের বাহার দেখায়। বাতাসে ফুলের সৌরভ ছড়ায়।
হেমন্ত কালে মাঠে মাঠে ধান কাটার ধূম৷ চারদিকে নতুন ধানের কেমন আবেশ করা গন্ধ৷ আকাশে ছিন্ন ভিন্ন মেঘের উপস্থিতি৷ ফুলের বনে তখনও শরতের আবেশ৷ এ সময় ফোটে ওঠে হাস্নাহেনা, মধুমঞ্জরি আর কুন্দ৷ হাস্নাহেনার নলাকার সাদাটে ফুল ফোটে সন্ধ্যায়৷ চারদিকে ছড়িয়ে দেয় সুগন্ধি আবেশ৷ সুগন্ধবাহী সাদা ও লাল রঙের মধু মঞ্জুরির ফুল ফোটে ঝুলন্ত থোকায়৷ কুন্দের ডালে দেখা মেলে গন্ধহীন গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা রঙের ফুল৷
বাগানে ফোটে নয়নাভিরাম ছাতিম ফুল। ছাতিমের তীব্র গন্ধবাহী ফুল গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে এর উপস্থিতির জানান দেয়৷ চারদিকে তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে এ সময় ফোটে দেব কাঞ্চনের হালকা বেগুনী বা সাদাটে ফুল৷
সি্নগ্ধতায় মোড়ানো এই হেমন্ত আসে যেন চুপি চুপি, আমাদের অলক্ষ্যে। কিন্তু হেমন্তের চিরচেনা গন্ধই আমাদের জানিয়ে দেয় তার আগমন বারতা। ছাতিমের প্রলোভনেই কি হেমন্ত আসে? না হেমন্তের হাত ধরে আসে ছাতিম? তবে এ কথা সত্যি, ছাতিমফুল ছাড়া হেমন্ত যেন নিষ্প্রাণ, ছন্দহীন, গন্ধহীন। ভাগ্যিস, ছাতিম এখনও দুর্লভ হয়ে ওঠেনি।
রাতে পথ চলতে চলতে হঠাৎ হেমন্তের বাতাসে ছাতিমের উদ্দাম গন্ধপ্রবাহ আপনাকে ব্যাকুল করতে পারে। 'শ্যামলী নিসর্গ' গ্রন্থে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা (বাংলাদেশ ) লিখেছেন, 'ছাতিমই বোধহয় একমাত্র বৃক্ষ যে হেমন্তের অঙ্গনে দাঁড়িয়ে প্রস্ফুটন আর সুগন্ধের পল্গাবনে এই দুরন্ত শীতকে অভ্যর্থনা জানায়। প্রস্ফুটনের এমন অবারিত উচ্ছ্বাস, ফুলের অক্লান্ত নির্ঝর এবং দূরবাহী প্রবল উগ্র গন্ধের ঐশ্বর্য আর কোনো হৈমন্তী তরুরই নেই'।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় 'আরণ্যক' গ্রন্থেও ছাতিমের উল্লেখ করেছেন। 'কিছুদূর উঠতেই কিসের মধুর সুবাসে মনপ্রাণ মাতিয়া উঠিল। গন্ধটা অত্যন্ত পরিচিত ... চারিদিকে চাহিয়া দেখি ধনঝরি পাহাড়ে যে এত ছাতিম গাছ আছে তাহা পূর্বে লক্ষ্য করি নাই। এখন প্রথম হেমন্তে ছাতিম গাছে ফুল ধরিয়াছে, তাহারই সুবাস। ... ছাতিম ফুলের সুবাস আরও ঘন হইয়া উঠিল, ছায়া গাঢ় হইয়া নামিল শৈলসানুর বনস্থলীতে ... ভানুমতী একগুচ্ছ ছাতিম ফুল পাড়িয়া খোপায় গুঁজিল (পৃ. ১৩৯)।'
ছাতিম ফুল নিয়ে চমৎকার কবিতা লিখেছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ।
‘ছাতিম ফুলের গন্ধে ভাসে পথ
উঠোন ভরে ভরলো ঘরের কোণ
জোছনা মেখে হচ্ছে আরো মিহি
সেই সোহাগে উঠলো ভরে মন।
....
গন্ধে কাঁপে ছাতিম ফুলের রাত
হাতের ভেতর মধুমতির হাত।’
গাছের ডালে বসে পাখি গান ধরে। এসব হেমন্তেরই নিদর্শন। হেমন্ত বাংলার নিজস্ব ঋতু হলেও এটি কখন আসে কখন যায় তা আমরা অনেকেই জানিনা। এটি শরৎ থেকে খুব একটা পৃথক নয়; শীত থেকে আবার খুব একটা দূরেও নয়। হেমন্তের রঙ ধূসর। বর্ষার মতো রুক্ষ নয় তার রূপ। তবে শীতের মতো শান্তও নয়। উদাসীন পথিকের মতো হেমন্তের হাঁটাচলা। আবার হেমন্ত একগুচ্ছ প্রিয় ঝারাপাতার বাহারও বটে। তাইতো হেমন্তের রূপে মুগ্ধ হয়ে কবিগুরু লিখেছেন-
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূণ্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার।’
অন্যান্য ঋতুর তুলনায় হেমন্তে খুব সামান্যই ফুল ফোটে। অনিন্দ্যসুন্দর হিমঝুরি, দেবকাঞ্চন, রাজ অশোক হেমন্তের প্রকৃতিকে মাতিয়ে রাখে।
হেমন্তের সকালে শিশিরভেজা ঘাসের ডগাকে মনে হয় মুক্তোর মালা। বাংলা সাহিত্যের একটা অংশ জুড়ে আছে শিশিরের নরম স্পর্শের বর্ণনা। কখন কোথা থেকে শিশির এসে ঘাসের ডগায় গাছের পাতায় মুক্তোর মালা পরিয়ে দিয়ে যায় তা কেউ জানেনা। আর সূর্যদয়ের সাথে সাথেই প্রকৃতিকে কাঁদিয়ে কোন সুদূরে মিলিয়ে যায় তাও মানুষের দৃষ্টির বাইরে। এ এক অবাক করার বিষয় রহস্যময়ও বটে। হেমন্তের সকালে শিশিরভেজা সকাল, দুপুরের রোদের স্নিগ্ধতা, সন্ধ্যায় বাঁশ ঝাড়ের শিরশির ধ্বনি প্রকৃতিতে ভিন্ন এক মাধুরীর সৃষ্টি করে।
হেমন্তের মেঘমুক্ত আকাশে রাতের জোছনার আলো অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশিই পরিলক্ষিত হয়। এ সময় রাতের পথে, ঘাটে, বনে, বাদাড়ে জোছনার আলো ঠিকরে পড়ে। এ সময় চাঁদের শরীর থেকে মোমের মত গলে পড়ে জোছনার আলো। হেমন্ত আসে ধীর পদক্ষেপে। শীতের পরশ গায়ে মেখে। তাইতো হেমন্তের রাতে শীত শীত অনুভব হয়।
হেমন্ত ঋতুর দু’টি মাস কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আদ্রা’ তারার নামানুসারে নাম রাখা হয়েছে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস। নদীমাতৃক এক সময় বাংলা বছরের গণনা শুরু হতো হেমন্ত মাস দিয়ে। কারণ, ধান কাটার মওসুম এ হেমন্ত। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ ধান বেড়ে উঠে শরতে। হেমন্তের প্রথম দিকে পাক ধরে। কার্তিকের শেষ দিকে গ্রামের মাঠে কৃষকেরা দলবেঁধে ধান কাটে।
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য় আ য় আয়।
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়॥
হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিগ্বধূরা ধানের ক্ষেতে--
রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে, মরি হা য় হা য় হায়॥
মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল।
ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো খোলো দুয়ার খোলো।
আলোর হাসি উঠল জেগে ধানের শিষে শিশির লেগে--
ধরার খুশি ধরে না গো, ওই-যে উথলে, মরি হা য় হা য় হায়॥
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার — চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,
তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,
দেহের স্বাদের কথা কয় –
বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট করে দেবে তার সাধের সময়!
চারি দিকে এখন সকাল –
রোদের নরম রঙ শিশুর গালের মতো লাল!
মাঠের ঘাসের পরে শৈশবের ঘ্রাণ –
পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান!
চারি দিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল!
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!
শরীর এলায়ে আসে এই খানে ফলন্ত ধানের মতো করে
যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায় তাহার ঠোটের চুমো ধ’রে
আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর,
চারি দিকে ছায়া — রোদ — ক্ষুদ — কুঁড়া — কার্তিকের ভিড়:
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এই খানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপাশালি ধান ভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ!
আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই — নুয়ে আছে নদীর এপারে
বিয়োবার দেরি না — রূপ ঝরে পড়ে তার –
শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে!
আজও তবুও ফুরায় নি বৎসরের নতুন বয়স,
মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ, ভাড়ারের রস!
মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়
সকালবেলা রৌদ্রে; কুঁড়িমির আজিকে সময়।
গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন্ ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া!
তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া;
ভুলে গিয়ে রাজ্য — জয় — সাম্রাজ্যের কথা
অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা;
ডেকে লব আইবুড় পাড়াগাঁর মেয়েদের সব –
মাঠের নিস্তেজ রোদের নাচ হবে –
শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।
হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে
কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;
ফলন্ত ধানের গন্ধে — রঙে তার — স্বাদে তার ভরে যাবে আমাদের সকলের দেহ;
রাগ কেহ করিবে না — আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ।
আমাদের অবসর বেশি নয — ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময়
আমাদের সকলের আগে শেষ হয়
দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ — অবসাদ –
আমাদের ডেকে লয় — তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা — অবসন্ন হাত।
তখন শস্যের গন্ধ ফুরায়ে গিয়েছে ক্ষেতে — রোদ গেছে পড়ে,
এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধরে;
তখন গিয়েছে থেমে অই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড়
হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালির
বিছানার পর;
মদের ফোঁটার শেষ হয়ে গেছে এ মাঠের মাটির ভিতর!
তখন সবুজ ঘাস হয়ে গেছে শাদা সব, হয়ে গেছে আকাশ ধবল,
চলে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদের দল!
--------------জীবনানন্দ দাশ
আকাশজুড়ে নীল মেঘের ছড়াছড়ি। প্রকৃতিতে মিষ্টি রোদের ঝিলিক। সবুজ পাতায় উপর খেলা করে সকালের সোনারোদ। নরম সকালে দূর্বাঘাসের ডগায় ফুটে ছোট ছোট শিশিরবিন্দু। দিগন্ত প্রসারিত মাঠে হলুদ ধানের জড়াজড়ি।আকাশে বাতাসে হৈমন্তী শোভা ,........... আসছেন ঋতুরাজকন্যা হেমন্ত। কবি জসিমউদ্দীন লিখেছেন-
‘সবুজ হলুদে সোহাগ ঢুলায়ে ধান ক্ষেত,
পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সাদা সঙ্কেত।
ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে,
ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়া পাখিগুলি শুয়েছে মাঠের পরে।
কৃষাণ কনের বিয়ে হবে হবে তার হলদি কোটার শাড়ি,
হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কচি রোদ রেখা-নাড়ি।’
ঝিমিয়ে থাকা লাউ গাছটা লকলকিয়ে বাড়তে থাকে। শিমগাছে সাদার ভেতর বেগুনি রঙের ফুল ফোটে। পাকা ধানের গন্ধে মৌ মৌ করে উত্তরের বাতাস। কানা বক মাছ ধরতে আসে নদীর তীরে। মাছরাঙা বসে থাকে পুকুরের গাছের ডালে। কাশফুল শরতের নিজস্ব ফুল হলেও হেমন্তে উঁচু টিলায় সাদা সাদা কাশফুল ফুটতে দেখা যায়। খালে-বিলে, হাওড়-বিলে, পুকুরে শাপলা ফুটে। গ্রাম্য কিশোর-কিশোরীরা দলবেঁধে ফুল তুলতে আসে। শরতে ফোটা শেফালি, স্থলপদ্ম হেমন্তেও রূপের বাহার দেখায়। বাতাসে ফুলের সৌরভ ছড়ায়।
হেমন্ত কালে মাঠে মাঠে ধান কাটার ধূম৷ চারদিকে নতুন ধানের কেমন আবেশ করা গন্ধ৷ আকাশে ছিন্ন ভিন্ন মেঘের উপস্থিতি৷ ফুলের বনে তখনও শরতের আবেশ৷ এ সময় ফোটে ওঠে হাস্নাহেনা, মধুমঞ্জরি আর কুন্দ৷ হাস্নাহেনার নলাকার সাদাটে ফুল ফোটে সন্ধ্যায়৷ চারদিকে ছড়িয়ে দেয় সুগন্ধি আবেশ৷ সুগন্ধবাহী সাদা ও লাল রঙের মধু মঞ্জুরির ফুল ফোটে ঝুলন্ত থোকায়৷ কুন্দের ডালে দেখা মেলে গন্ধহীন গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা রঙের ফুল৷
বাগানে ফোটে নয়নাভিরাম ছাতিম ফুল। ছাতিমের তীব্র গন্ধবাহী ফুল গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে এর উপস্থিতির জানান দেয়৷ চারদিকে তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে এ সময় ফোটে দেব কাঞ্চনের হালকা বেগুনী বা সাদাটে ফুল৷
সি্নগ্ধতায় মোড়ানো এই হেমন্ত আসে যেন চুপি চুপি, আমাদের অলক্ষ্যে। কিন্তু হেমন্তের চিরচেনা গন্ধই আমাদের জানিয়ে দেয় তার আগমন বারতা। ছাতিমের প্রলোভনেই কি হেমন্ত আসে? না হেমন্তের হাত ধরে আসে ছাতিম? তবে এ কথা সত্যি, ছাতিমফুল ছাড়া হেমন্ত যেন নিষ্প্রাণ, ছন্দহীন, গন্ধহীন। ভাগ্যিস, ছাতিম এখনও দুর্লভ হয়ে ওঠেনি।
রাতে পথ চলতে চলতে হঠাৎ হেমন্তের বাতাসে ছাতিমের উদ্দাম গন্ধপ্রবাহ আপনাকে ব্যাকুল করতে পারে। 'শ্যামলী নিসর্গ' গ্রন্থে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা (বাংলাদেশ ) লিখেছেন, 'ছাতিমই বোধহয় একমাত্র বৃক্ষ যে হেমন্তের অঙ্গনে দাঁড়িয়ে প্রস্ফুটন আর সুগন্ধের পল্গাবনে এই দুরন্ত শীতকে অভ্যর্থনা জানায়। প্রস্ফুটনের এমন অবারিত উচ্ছ্বাস, ফুলের অক্লান্ত নির্ঝর এবং দূরবাহী প্রবল উগ্র গন্ধের ঐশ্বর্য আর কোনো হৈমন্তী তরুরই নেই'।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় 'আরণ্যক' গ্রন্থেও ছাতিমের উল্লেখ করেছেন। 'কিছুদূর উঠতেই কিসের মধুর সুবাসে মনপ্রাণ মাতিয়া উঠিল। গন্ধটা অত্যন্ত পরিচিত ... চারিদিকে চাহিয়া দেখি ধনঝরি পাহাড়ে যে এত ছাতিম গাছ আছে তাহা পূর্বে লক্ষ্য করি নাই। এখন প্রথম হেমন্তে ছাতিম গাছে ফুল ধরিয়াছে, তাহারই সুবাস। ... ছাতিম ফুলের সুবাস আরও ঘন হইয়া উঠিল, ছায়া গাঢ় হইয়া নামিল শৈলসানুর বনস্থলীতে ... ভানুমতী একগুচ্ছ ছাতিম ফুল পাড়িয়া খোপায় গুঁজিল (পৃ. ১৩৯)।'
ছাতিম ফুল নিয়ে চমৎকার কবিতা লিখেছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ।
‘ছাতিম ফুলের গন্ধে ভাসে পথ
উঠোন ভরে ভরলো ঘরের কোণ
জোছনা মেখে হচ্ছে আরো মিহি
সেই সোহাগে উঠলো ভরে মন।
....
গন্ধে কাঁপে ছাতিম ফুলের রাত
হাতের ভেতর মধুমতির হাত।’
গাছের ডালে বসে পাখি গান ধরে। এসব হেমন্তেরই নিদর্শন। হেমন্ত বাংলার নিজস্ব ঋতু হলেও এটি কখন আসে কখন যায় তা আমরা অনেকেই জানিনা। এটি শরৎ থেকে খুব একটা পৃথক নয়; শীত থেকে আবার খুব একটা দূরেও নয়। হেমন্তের রঙ ধূসর। বর্ষার মতো রুক্ষ নয় তার রূপ। তবে শীতের মতো শান্তও নয়। উদাসীন পথিকের মতো হেমন্তের হাঁটাচলা। আবার হেমন্ত একগুচ্ছ প্রিয় ঝারাপাতার বাহারও বটে। তাইতো হেমন্তের রূপে মুগ্ধ হয়ে কবিগুরু লিখেছেন-
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূণ্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার।’
অন্যান্য ঋতুর তুলনায় হেমন্তে খুব সামান্যই ফুল ফোটে। অনিন্দ্যসুন্দর হিমঝুরি, দেবকাঞ্চন, রাজ অশোক হেমন্তের প্রকৃতিকে মাতিয়ে রাখে।
হেমন্তের সকালে শিশিরভেজা ঘাসের ডগাকে মনে হয় মুক্তোর মালা। বাংলা সাহিত্যের একটা অংশ জুড়ে আছে শিশিরের নরম স্পর্শের বর্ণনা। কখন কোথা থেকে শিশির এসে ঘাসের ডগায় গাছের পাতায় মুক্তোর মালা পরিয়ে দিয়ে যায় তা কেউ জানেনা। আর সূর্যদয়ের সাথে সাথেই প্রকৃতিকে কাঁদিয়ে কোন সুদূরে মিলিয়ে যায় তাও মানুষের দৃষ্টির বাইরে। এ এক অবাক করার বিষয় রহস্যময়ও বটে। হেমন্তের সকালে শিশিরভেজা সকাল, দুপুরের রোদের স্নিগ্ধতা, সন্ধ্যায় বাঁশ ঝাড়ের শিরশির ধ্বনি প্রকৃতিতে ভিন্ন এক মাধুরীর সৃষ্টি করে।
হেমন্তের মেঘমুক্ত আকাশে রাতের জোছনার আলো অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশিই পরিলক্ষিত হয়। এ সময় রাতের পথে, ঘাটে, বনে, বাদাড়ে জোছনার আলো ঠিকরে পড়ে। এ সময় চাঁদের শরীর থেকে মোমের মত গলে পড়ে জোছনার আলো। হেমন্ত আসে ধীর পদক্ষেপে। শীতের পরশ গায়ে মেখে। তাইতো হেমন্তের রাতে শীত শীত অনুভব হয়।
হেমন্ত ঋতুর দু’টি মাস কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আদ্রা’ তারার নামানুসারে নাম রাখা হয়েছে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস। নদীমাতৃক এক সময় বাংলা বছরের গণনা শুরু হতো হেমন্ত মাস দিয়ে। কারণ, ধান কাটার মওসুম এ হেমন্ত। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ ধান বেড়ে উঠে শরতে। হেমন্তের প্রথম দিকে পাক ধরে। কার্তিকের শেষ দিকে গ্রামের মাঠে কৃষকেরা দলবেঁধে ধান কাটে।
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য় আ য় আয়।
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়॥
হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিগ্বধূরা ধানের ক্ষেতে--
রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে, মরি হা য় হা য় হায়॥
মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল।
ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো খোলো দুয়ার খোলো।
আলোর হাসি উঠল জেগে ধানের শিষে শিশির লেগে--
ধরার খুশি ধরে না গো, ওই-যে উথলে, মরি হা য় হা য় হায়॥