নিত্যদিনের বিভিন্ন খাবারে ধনেপাতা ব্যবহার করে থাকেন খাবারের গন্ধ এবং স্বাদে একটা পরিবর্তন আনার জন্য। ধনেপাতার বৈজ্ঞানিক নাম হল কোরিয়ানড্রাম স্যাটিভাম।
ধনে পাতার স্বাদ ও গন্ধের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকেন না এমন ব্যক্তি কিন্তু খুব কম-ই আছে। প্রায় সব ধরনের তরকারিতেই ধনে পাতা স্বাদ বৃদ্ধি করে থাকে; সেই সাথে যুক্ত করে অসাধারণ ঘ্রাণ। ধনে পাতা কি শুধু স্বাদে গন্ধেই অনন্য? খাদ্য ও পুষ্টিগুণ বিচারে ধনে পাতার উপকারিতা বর্ণনাতীত।
ধনে পাতার পুষ্টিগুণ
ধনে পাতার উপকারিতা না জেনেই অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত বিভিন্ন তরকারিতে এটি খেয়ে আসছে। ধনে পাতায় রয়েছে ১১ জাতের এসেনশিয়াল অয়েল, ৬ ধরণের অ্যাসিড (অ্যাসকরবিক অ্যাসিড যা ভিটামিন সি নামেই বেশি পরিচিত), ভিটামিন, মিনারেল এবং অন্যান্য উপকারী পদার্থ।
ধনে পাতা কী কী উপকার করে থাকে?
- ধনে পাতায় উপস্থিত সিনিওল এসেনশিয়াল অয়েল এবং লিনোলিক অ্যাসিড থাকে যার মধ্যে অ্যান্টিরিউম্যাটিক এবং অ্যান্টি-আর্থ্রাইটিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এরা ত্বকের জ্বালাপোড়া এবং ফুলে যাওয়া কমাতে সাহায্য করে।
- ডিসইনফেকট্যান্ট, ডিটক্সিফাইং বা বিষাক্ততা রোধকারী, অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকার কারণে এরা বিভিন্ন স্কিন ডিজঅর্ডার বা ত্বকের অসুস্থতা (একজিমা, ত্বকের শুষ্কতা এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশন) সারাতে সাহায্য করে। ত্বক সুস্থ ও সতেজ রাখতে তাই ধনে পাতার উপকারিতা অনেক।
- ধনে পাতায় থাকে লিনোলিক, অলিক, পাল্মিটিক, স্টেরিক এবং অ্যাসকরবিক অ্যাসিড যা শরীরের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
- বর্নেওল এবং লিনালোল অন্ত্রের কার্যকারিতা স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। ফলে যকৃত ও বাওয়েল সুস্থ থাকে এবং ডায়রিয়া কমাতেও সাহায্য করে। মাইক্রোবিয়াল এবং ফাঙ্গাল প্রতিক্রিয়ার কারণে ডায়রিয়া হোলে সেটা সারিয়ে তুলে। বমি বমি ভাব, বমি হওয়া এবং অন্যান্য পাকস্থলীর সমস্যা সমাধানে ধনে পাতার উপকারিতা অপরিসীম।
- ক্যালসিয়াম আয়ন এবং কলিনার্জিক বা অ্যাসেটিকোলিন উপাদান মিলে আমাদের শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
- মুখের আলসার দূর করতে সহায়তা করে।
- ধনে পাতায় প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকায় এরা রক্তশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে।
- অ্যান্টি হিস্টামিন উপাদান থাকায় এরা অ্যালার্জি বা এর ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে দূরে রাখে।
- খাবারের মাধ্যমে সৃষ্ট সবচেয়ে ভয়াবহ রোগ সালমোনেলা। ধনে পাতায় উপস্থিত ডডেসিনাল উপাদান প্রাকৃতিক উপায়ে সালমোনেলা জাতীয় রোগ সারিয়ে তুলতে অ্যান্টিবায়টিকের থেকে দ্বিগুণ কার্যকর।
- ধনে পাতায় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম আছে। হাড় মজবুত এবং সুস্থ রাখতে ধনে পাতার উপকারিতা অনেক।
- এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিইনফেকসাস্, ডিটক্সিফাইং, ভিটামিন সি এবং আয়রন গুটিবসন্ত প্রতিকার এবং প্রতিরোধ করে।
- মহিলাদের মাসিকের সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে।
- ধনে পাতায় উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি এবং মিনারেল (যেমনঃ ফসফরাস) চোখের যত্নে খুবই উপকারী। এর মধ্যে থাকা মাইক্রোবিয়াল উপাদান ছোঁয়াচে রোগ (যেমনঃ কনজাংটিভাইটিস) থেকেও চোখকে রক্ষা করে।
- এরা শরীরের ইনসুলিন নিঃসরণের মাত্রা বাড়িয়ে রক্তে সুগার এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
- বিভিন্ন ভেষজ পদার্থের সাথে মিশিয়ে যৌনশক্তি বৃদ্ধি করতে ধনে পাতার উপকারিতা অনেক।
কিন্তু কখনও কি কল্পনা করেছেন যে এই সুস্বাদু খাবারটির কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি কথা হল, এই সুপরিচিত সবুজ সবজিটির অনেক ঔষধি গুণাগুণের পাশাপাশি অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও বিদ্যমান। যা নিয়মিত খেলে আমাদের শরীর দিনদিন অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরা অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
অনেকের ক্ষেত্রে সূর্যরশ্মির সংবেদনশীলতা বা সানলাইট সেনসিটিভিটি দেখা দিতে পারে এবং অত্যাধিক মাত্রায় খাওয়া হোলে সানবার্ন হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে এরকম হতে থাকলে স্কিন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
লিভারের ক্ষতিসাধন অতিরিক্ত ধনেপাতা খেলে এটি লিভারের কার্যক্ষমতাকে খারাপভাবে প্রভাবিত করে থাকে। এতে থাকা এক ধরনের উদ্ভিজ তেল শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে ফেলে। এছাড়া এটাতে এক ধরনের শক্তিশালী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে যেটা সাধারণত লিভারের বিভিন্ন সমস্যা দূর করে কিন্তু দেহের মাঝে এর অতিরিক্ত মাত্রার উপস্থিতি লিভারের ক্ষতিসাধন করে। নিম্ন রক্তচাপ অতিরিক্ত ধনেপাতা খাওয়ার ফলে দেহের হৃৎপিন্ডের স্বাস্থ্য নষ্ট করে ফেলে, যার ফলে নিম্ন রক্তচাপ সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞরা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এই ধনেপাতা খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাই এটি অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে নিম্ন রক্তচাপের উদ্ভব ঘটতে পারে। এছাড়া এটি হালকা মাথাব্যথারও উদ্রেক করতে পারে।
পেট খারাপ স্বাভাবিকভাবে ধনেপাতা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল বিষয়ক সমস্যা দূর করে থাকে কিন্তু বেশি পরিমাণে ধনেপাতা সেবন পাকস্থলীতে হজমক্রিয়ায় সমস্যা তৈরি করে থাকে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে এক সপ্তাহে ২০০ এমএল ধনেপাতা আহারে গ্যাসের ব্যথা ওঠা, পেটে ব্যথা, পেট ফুলে ওঠা, বমি হওয়া হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা যায়। ডায়রিয়া ধনেপাতা অল্প খেলে পেটের সমস্যা দূর হয় কিন্তু এটি বেশি পরিমাণে খেলে ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এছাড়া এর ফলে ডিহাইড্রেশন হতে থাকে। ফলে ডায়রিয়ার সমস্যাটি হতেই থাকে। তাই এই ধরনের সমস্যা এড়াতে প্রতিদিনের খাবারে ধনেপাতা কম পরিমাণে ব্যবহার করুন।
নিঃশ্বাসের সমস্যা আপনি যদি শ্বাসকষ্টের রোগী হয়ে থাকেন তাহলে এই ধনেপাতা আহার থেকে বিরত থাকুন। কেননা এটি আপনার শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা করে থাকে যার ফলে ফুসফুসে অ্যাজমার সমস্যা হতে পারে। এই ধনেপাতা খেলে মাঝে মাঝে ছোট ছোট নিশ্বাস নিতেও সমস্যা তৈরি হয়। বুকে ব্যথা অতিরিক্ত ধনেপাতা আহারে বুকে ব্যথার মত জটিল সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এটা শুধুমাত্র অস্বস্তিকর ব্যথাই সৃষ্টি করে না তা দীর্ঘস্থায়ীও হয়ে থাকে।
এজন্য এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে দৈনন্দিন আহারে কম করে এই ধনেপাতা খেতে পারেন। ত্বকের সংবেদনশীলতা সবুজ ধনেপাতাতে মোটামুটিভাবে কিছু ঔষধি অ্যাসিডিক উপাদান থাকে যেটি ত্বককে সূর্যরশ্মি থেকে বাঁচিয়ে সংবেদনশীল করে থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত সেবনে সূর্যের রশ্মি একেবারেই ত্বকের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না ফলে ত্বক ভিটামিন কে থেকে বঞ্চিত হয়। এছাড়া ধনেপাতা ত্বকের ক্যান্সার প্রবণতাও তৈরি করে থাকে। অ্যালার্জীর সমস্যা ধনেপাতার প্রোটিন উপাদানটি শরীরে আইজিই নামক অ্যান্টিবডি তৈরি করে যা শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানকে সমানভাবে বহন করে থাকে।
কিন্তু এর অতিরিক্ত মাত্রা উপাদানগুলোর ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে। ফলে অ্যালার্জীর তৈরি হয়। এই অ্যালার্জীর ফলে দেহে চুলকানি, ফুলে যাওয়া, জ্বালাপোড়া করা, র্যা শ ওঠা এই ধরনের নানা সমস্যা হয়ে থাকে। প্রদাহ অতিরিক্ত ধনেপাতা সেবনের আরেকটি বিশেষ পার্শ্ব প্রতক্রিয়া হল মুখে প্রদাহ হওয়া। এই ঔষধিটির বিভিন্ন এসিডিক উপাদান যেটি আমাদের ত্বককে সংবেদনশীল করে থাকে পাশাপাশি এটি মুখে প্রদাহেরও সৃষ্টি করে। বিশেষ করে এর ফলে ঠোঁট, মাড়ি এবং গলা ব্যথা হয়ে থাকে।
এর ফলে সারা মুখ লাল হয়েও যায়। ভ্রূণের ক্ষতি গর্ভকালীন সময়ে অতিরিক্ত ধনেপাতা খাওয়া ভ্রূণের বা বাচ্চার শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকারক। ধনেপাতাতে থাকা কিছু উপাদান মহিলাদের প্রজনন গ্রন্থির কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে ফেলে যার ফলে মহিলাদের বাচ্চা ধারণ ক্ষমতা লোপ পায় এবং বাচ্চা ধারণ করলেও গর্ভকালীন ভ্রূণের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন