শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

বর্ষার অনন্য ফুল

বর্ষা বাংলাকে আপন করে বিলিয়ে দেয় এবং এর ফুলের সৌন্দর্য আমাদের করে তোলে সম্পদশালী,শ্রীমন্ডিত  । মূলত: বর্ষা বলতে আমরা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসকে কাগুজে জানা জেনে থাকি। কিন্তু বাংলার অনেক অঞ্চলেই বর্ষা মানে ছ’মাসের বর্ষা। আর এই ছ’মাসব্যাপী নাম জানা, নাম না জানা অনেক ফুল ফোটে, ঝরে, যার কোনো ইতিহাস লেখা হয় না।
বর্ষার যে ফুলগুলো আমাদের দৃষ্টিকে সচকিত করে তা হলো কেয়া, কদম, কলাবতী, শাপলা, পদ্ম, ঘাসফুল, পানাফুল, কলমী ফুল, কচুফুল, ঝিঙেফুল, কুমড়াফুল, হেলেঞ্চাফুল, কেশরদাম,  পাতা শেওলা, কাঁচকলা, পাটফুল, বনতুলসী, নলখাগড়া, ফণীমনসা, উলটকম্বল, কেওড়া, গোলপাতা, শিয়ালকাটা, কেন্দার এবং এছাড়া নানা রঙের অর্কিড। বাংলার বর্ষাকালের প্রধান কয়েকটি ফুলের পরিচিতি এখানে তুলে ধরছি।



"বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
 আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।।
 মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে
 এই যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান।।
 আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল
 রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।"
কদম :  কদমফুল বিরহের প্রতীক। কবে কোন রাধিকা বাঁশীর কলধ্বনিতে কদমগাছের তলে ছুটে গিয়েছিলেন তা আজ আর কারুর জানা নেই। আজ আর সেই কৃষ্ণ নেই। বাঁশী নেই কিন্তু চির বিরহের হাহাকার আছে। আছে রাধাকৃষ্ণের নতুন সংস্করণ। আজও বর্ষায় কদমফুল বেয়ে অশ্রু ঝরে। কবির মনেও দোলা লাগে।
“তখন কেবল ভরিছে গগন মেঘে/কদম-বোরক দুলিছে বাদল বাতাস লেগে।”
এই কদমফুল  এর বৈজ্ঞানিক  সাধারণত: ভারত ,বাংলাদেশ, নেপাল ও মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলে পাওয়া যায়। কদম গাছ সাধারণত: ৩০/৪০ ফুট লম্বা হয়। প্রস্থ ঊর্ধ্বে ৫ থেকে ৭ ফুট হয়। ফুল গোলাকৃতি লম্বা বৃন্তে দ-ায়মান। ফুলের রং হলুদ সাদায় মেশানো। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেই এই ফুল ফোটে। ঐতিহ্যবাহী এই ফুল এখনও গ্রাম-বাংলার আনাচে-কানাচে, পথের পাশে নদীর ধারে কিংবা কোনো কোনো উদ্যানে পাওয়া যায়। আমাদের ঐতিহ্যে ও সাহিত্যে কদম গাছ ও ফুল ২০০০ বছরের পুরনো। বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ প্রথম এই কদম গাছে উঠে বাঁশী বাজান এবং তার দয়িতা শ্রীরাধিকাকে আকৃষ্ট করেন।
এই ফুলের সৌন্দর্য আছে কিন্তু গন্ধ নেই। এর পাতা মাথলা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। কদমফুল ছেলে-মেয়েদের খেলনার কাজে ব্যবহৃত হয়। কদম গাছ তক্তা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। কেউ কেউ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে।



"কেয়া পাতার নৌকা গড়ে
সাজিয়ে দেব ফুলে
তাল দীঘিতে ভাসিয়ে দেব
চলবে দুলে দুলে...।"


কেয়া : আবহমানকাল ধরে বাংলার ঘরে ঘরে কেয়াফুলের সুগন্ধের খ্যাতি শ্যামল রং রমণীর সুনামের মতোই ছড়িয়ে আছে। বর্ষাকালে কদমফুল দেয় যেমন দৃশ্যের আনন্দ সেরকম এই কেয়া ফুল দেয় সৌরভের গৌরব।
এই ফুল  ভারত,বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, আফ্রিকার গ্রীষ্মম-ল এবং অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়।  এর পাতা সরু লম্বা এবং কাঁটাযুক্ত। ফুলগুলো শ্বেতবর্ণ, ধানের ছড়ার মতো বিন্যস্ত এবং উগ্র সুবাসযুক্ত। এর বায়বীয় মূল কা- থেকে ঝুলে পড়ে বায়ু থেকে খাদ্য উপাদান নাইট্রোজেন গ্রহণ করে।
অনেক সময় ফুলগুলো পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। এর ঘ্রাণে বিমুগ্ধ হয়ে সাপ ও বিষাক্ত কীটপতঙ্গ গাছে জড়িয়ে থাকে। সুন্দরকে তুলতে যেয়ে মৃত্যু নামক অসুন্দরের কোলে ঢলে পড়তে হয় অনেককেই।
পারজিউম তৈরি করতে এর রস ব্যবহৃত হয়। গ্রাম্য মেয়েরা সৌন্দর্য চর্চায় এই ফুল অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করে।



কলাবতী : বর্ষার এক অনন্য ফুল। রবীন্দ্রনাথ এর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে নাম রেখেছিলেন  সর্বজয়া। গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে কিংবা শহরের বিলাসী বাগানে লাল-হলুদ এবং লাল ও হলুদ মেশানো কলাবতী ফুল পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।  এর ৫৫টি প্রজাতি রয়েছে। এগুলো বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। দেখতে সরু, লম্বায় ৩ থেকে ৫ ফুট, পাতা দুই প্রান্তের দিকে চাপা, মাঝখানে প্রশস্ত। এগুলো একবীজপত্রী উদ্ভিদ। ৩টি বৃন্তযুক্ত এই ফুলে ৫টি পাপড়ি রয়েছে। ফুলের মাঝখানে দন্ডায়মান  বৃহৎ পুংকেশর। ফুলের আকৃতি গোড়ার দিকে সরু অগ্রভাগ ছড়ানো।
 ভারত ছাড়া বাংলাদেশ, আমেরিক, ব্রাজিল ও আফ্রিকাতে এই ফুল পাওয়া যায়। সাধারণত: স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় জন্মে।  বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ছাড়া কলাবতীর অন্য কোন অর্থনৈতিক উপযোগিতা নেই।



শাপলা বা শালুক ফুল : বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা লাভের পর এই ফুল জাতীয় ফুলের মর্যাদা লাভ করেছে। সাংস্কৃতির প্রতীক পদ্মফুলের সমতূল্যতা লাভ করে এই শাপলা। বাংলাদেশের খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর-ডোবা সর্বত্রই পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ছাড়া অন্যত্রও পরিলক্ষিত হয়। জেলে, মাঝি, মুটে, কুলি থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের লোকের হৃদয় হরণকারী এই ফুল। আমাদের কাছে এগুলো আটপৌরে মনে হলেও আজ অনন্যতায় ভাস্বরিত।
শাপলার  পরিবারে ৮টি গোত্র ও ৯০টি প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শাপলা জাতীয় প্রজাতি হল সাদা বা লাল শাপলা, হলদে শাপলা, নীল শাপলা ও বড় শাপলা।


শাপলার সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য
১. জলজ-বীরুৎ
২. পাতা-বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার
৩. কান্ড -রাইজাম জাতীয়
৪. পুষ্প-একক এবং লম্বা বৃন্ত বিশিষ্ট
৫. পাপড়ি-ক্রমান্বয়ে পুংকেশরে রূপান্তরিত হয়।
শাপলার কাণ্ডে  পাতায়, ফুলে বায়ু কুঠুরি নামক কাঁপানো জায়গা থাকাতে এগুলো জলে ভাসতে পারে। দুই করমের ভাসমান উদ্ভিদের মাঝে এগুলো হলো নোঙরবদ্ধ ভাসমান উদ্ভিদ। এদের শিকড় জলের তলদেশে কাদায় আটকানো থাকে। পাতা ফুল জলে ভাসে। ভাসমান পাতার উপরিভাগে অনেকগুলো পত্ররন্ধ্র থাকে যার দ্বারা উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে থাকে।
 তাছাড়া শাপলা ফুল এবং পাতা সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর ফুলের নাম ঢেপ। যার থেকে সুস্বাদু এবং ছোট ছোট গোলাকার মুড়ি তৈরি হয়ে থাকে। এই মুড়ি থেকে মোয়াও তৈরি হয়। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ফুলের ডাঁটা ভেঙে সুন্দর সুন্দর গহনা বানিয়ে গলায় পরিধান করে। এছাড়া এ ফুল পুকুর-ডোবা, খাল-বিলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। 

পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে

পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে
চেনাশোনার কোন বাইরে
যেখানে পথ নাই নাই রে
সেখানে অকারণে যায় ছুটে
ঘরের মুখে আর কি রে
কোনো দিন সে যাবে ফিরে।
যাবে না, যাবে না
দেয়াল যত সব গেল টুটে
বৃষ্টি নেশা ভরা সন্ধ্যাবেলা
কোন বলরামের আমি চেলা,
আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে
যত মাতাল জুটে।
যা না চাইবার তাই আজি চাই গো,
যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো।
পাব না, পাব না,
মরি অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে

আয় তবে সহচরী

আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি
নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান
আন তবে বীণা
সপ্তম সুরে বাঁধ তবে তান
পাশরিব ভাবনা, পাশরিব যাতনা,
রাখিব প্রমোদে ভরি দিবানিশি মনপ্রাণ
আন তবে বীণা
সপ্তম সুরে বাঁধ তবে তান
ঢালো ঢালো শশধর, ঢালো ঢালো জোছনা
সমীরণ, বহে যা রে ফুলে ফুলে ঢলি ঢলি
উলসিত তটিনী,
উথলিত গীতরবে খুলে দে রে মনপ্রাণ

শাওন গগনে

শাওন গগণে ঘোর ঘনঘটা,
নিশীথ য়ামিনী (যামিনী) রে
কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব
অবলা কামিনী রে
উন্মদ পবনে য়মুনা (যমুনা) তর্জিত,
ঘন ঘন গর্জিত মেহ
দমকত বিদ্যুৎ, পথতরু লুণ্ঠিত,
থরহর কম্পিত দেহ
ঘন ঘন রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম
বরখত নীরদপুঞ্জ
শাল-পিয়ালে তাল-তমালে
নিবিড় তিমিরময় কুঞ্জ
কাহ রে সজনী, এ দুরুয়োগে (দুরুযোগে)
কুঞ্জে নিরদয় কান
দারুণ বাঁশী কাহ বাজায়ত
সকরুণ রাধা নাম
মোতিম হারে বেশ বনা দে,
সীঁথি লগা দে ভালে
উরহি বিলুন্ঠিত লোল চিকুর মম
বাঁধহ চম্পক মালে
গহন রয়নমে ন যাও, বালা,
নওল কিশোরক পাশ
গরজে ঘন ঘন, বহু ডর পাওব,
কহে ভানু তব দাস

পাশ্চাত্য দেশে যেমন বসন্ত কালকে ফুলের ঋতু বলা হয়, তেমন বাংলার বর্ষাকালকে ফুলের ঋতু হিসেবে ধরে নিতে পারি। আবহমান কাল ধরেই বাংলাকে বর্ষার ফুল স্বাতন্ত্র্য দিয়ে আসছে। এদের উজ্জ্বল উপস্থিতি  প্রেমিক-প্রেমিকাদের মনে রং লাগিয়ে আসছে। অতুলনীয় ফুলের সৌন্দর্য্যরে সঙ্গে সঙ্গে প্রেমিকাও হয়ে উঠছে প্রেমিকের নিকট আকর্ষণীয়। বর্ষা নামলেই হাত চলে যায় প্রিয়ার খোঁপায় আর চোখ চলে যায় জানালার ফাঁক দিয়ে। হৃদয়ে জাগে অনন্য কবিতার পঙ্ক্তিমালা:--
“আঁধারে ডুবিছে সবি
কেবল হৃদয়ে হৃদি অনুভবি।”
 সৌন্দর্য তত্ত্ববিদরা যেমন মনে করেন ফুল শুধু আপনার জন্যেই ফোটে না- তেমনি ফুল বিশেষজ্ঞ একজন বিজ্ঞানীর কাছে বৈপরীত্য দেখা দেয় তিনি মনে করেন -ফুল শুধু আপনার জন্যেই ফোটে। তিনি আরো মনে করেন ফুলের পাপড়ির এই রঙিন সমারোহ শুধু প্রজাপতি ও কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করার জন্যেই। বিশেষ করে পরাগায়ণের স্বার্থে। পরগায়ণ দ্বারা পুংগ্যামেট স্ত্রী গ্যামেটের সংস্পর্শে এসে নিষিক্তকরণ ঘটায়। জাইহেট গঠনের মাধ্যমে আমরা ফল ও বীজ পেয়ে থাকি।
এই বীজ শেষ অবদি আর একটি সুন্দর ফুলের বর্ষাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। আবহমান কাল ধরে ¯্রােতোচ্ছটায় প্রবাহিত করে বাংলার বর্ষা আর বর্ষাকালীন বিচিত্র ফুলকে। যে ফুল  সৌন্দর্য দেয়, গান দেয়, প্রেম দেয়, কর্মোদ্দীপনা দেয়, অলংকার দেয়, সমৃদ্ধি দেয়, দেয় অপার আনন্দ। তাই তো প্রত্যয় দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারিত হয় বর্ষা ও তার ফুল বাংলার আত্মা, এর প্রকাশ মানেই হৃদয় থেকে হৃদয়ের প্রকাশ। শ্রাবণ গগনে ঘোর ঘনঘটা। ...........................

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন