“অনেককাল পূর্বে শিলাইদহ থেকে কলকাতায় আসছিলেম। কুষ্টিয়া স্টেশনঘরের পিছনের
দেয়ালঘেঁষা এক কুরচিগাছ চোখে পড়ল । সমস্ত গাছটি ফুলের ঐশ্বর্যে
মহিমান্বিত। চারি দিকে হাটবাজার ; এক দিকে
রেলের লাইন , অন্য দিকে গরুর গাড়ির ভিড় , বাতাস ধুলোয় নিবিড়। এমন অজায়গায়
পি.ডব্লু.ডি-র স্বরচিত প্রাচীরের গায়ে ঠেস দিয়ে এই একটি কুরচিগাছ তার সমস্ত
শক্তিতে বসন্তের জয়ঘোষণা করছে— উপেক্ষিত বসন্তের প্রতি তার অভিবাদন সমস্ত
হট্টগোলের উপরে যাতে ছাড়িয়ে ওঠে এই যেন তার প্রাণপণ চেষ্টা । কুরচির সঙ্গে
এই আমার প্রথম পরিচয়।“
~রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
~রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কুরচি (Kurchi)
কুরচি একটি প্রাচীন ভারতীয় ফুল, ঋগ্বেদে আর উল্লেখ আছে,এর আদি নামটি হলো কুরুবক ,এই ফুলকে কেউ কেউ কূটরাজ নামেও ডাকে। সাদা মেঘের মতো গাছে ঢেউ খেলে খুশবু ছড়িয়ে কুরচির পাপড়ি ঝরে ঝরে পড়ছে। সুগন্ধি কুরচি গ্রীষ্মের ফুল। সিঙ্গেল টগরের মতো থোকায় থোকায় এ ফুল ফোটে। ফুল ফোটার সময় গাছ পাতাশূন্য হয়ে যায়। দিনে কুরচি চুপচাপ থাকলেও সন্ধ্যায় সে মিষ্টি গন্ধে জেগে ওঠে। পুরো তল্লাট মাতাল করে দেয়। শিকড় থেকে এর চারা হয়। কবিরাজি ওষুধে কুরচির ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে। ফুলটির আদি নিবাস ভারতে।ওঙ্কার ধামে বেশ কয়েকটি কুরচি গাছ আছে।
ইংরেজী নাম bitterer
বৈজ্ঞানিক নামঃ Holarrhena antidysenterica
কুরচির ছালে রয়েছে হোলাডিনেমাইন, কুরচাসিন, কোনিমাইন, হোলডিসিন আর সিটেস্টেরল নামক অ্যালকালয়েড। কুরচি ছাল রক্ত আমাশয় ও রক্তপিত্তের ঔষধ। এছাড়া পাতা, শিকড় ও বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
কুরচির সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে মহাকবি কালিদাস ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বন্দনা করেছেন বারবার। মহাকবির মেঘদূত কাব্যে আর বিশ্বকবি তার বনবাণী, পুনশ্চ, শ্যামলী, আকাশ প্রদীপের অনেক জায়গায় কুরচি সম্পর্কে লিখেছেন।
বনবাণী গ্রন্থের কুরচি কবিতার কয়েকটি লাইন-
“ভ্রমর একদা ছিল পদ্মবনপ্রিয় ,
ছিল প্রীতি কুমুদিনী পানে ।
সহসা বিদেশে আসি , হায় , আজ কি ও
কূটজেও বহু বলি মানে!
কুরচি , তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা
যে ভ্রমর , শুনি নাকি তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা ।
আমি সেই ভ্রমরের দলে । তুমি আভিজাত্যহীনা ,
নামের গৌরবহারা ; শ্বেতভুজা ভারতীয় বীণা
তোমারে করে নি অভ্যর্থনা অলংকারঝংকারিত
কাব্যের মন্দিরে । তবু সেথা তব স্থান অবারিত ,
বিশ্বলক্ষ্মী করেছেন আ মন্ত্রণ যে প্রাঙ্গণতলে
প্রসাদচিহ্নিত তাঁর নিত্যকার অতিথির দলে ।
আমি কবি লজ্জা পাই কবির অন্যায় অবিচারে
হে সুন্দরী । শাস্ত্রদৃষ্টি দিয়ে তারা দেখেছে তোমারে ,
রসদৃষ্টি দিয়ে নহে ; শুভদৃষ্টি কোনো সুলগনে
ঘটিতে পারে নি তাই , ঔদাস্যের মোহ-আবরণে
রহিলে কুণ্ঠিত হয়ে । “
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন