রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

গোলাপ

"বলি, ও আমার গোলাপ-বালা, বলি, ও আমার গোলাপ-বালা—
তোলো মুখানি, তোলো মুখানি— কুসুমকুঞ্জ করো আলা
বলি, কিসের শরম এত ! সখী, কিসের শরম এত !
সখী, পাতার মাঝারে লুকায়ে মুখানি কিসের শরম এত ।
বালা, ঘুমায়ে পড়েছে ধরা । সখী, ঘুমায় চন্দ্রতারা ।
প্রিয়ে, ঘুমায় দিক্‌বালারা সবে— ঘুমায় জগৎ যত ।
বলিতে মনের কথা, সখী, এমন সময় কোথা ।
প্রিয়ে, তোলো মুখানি, আছে গো আমার প্রাণের কথা কত ।
আমি এমন সুধীর স্বরে, সখী, কহিব তোমার কানে—
প্রিয়ে, স্বপনের মতো সে কথা আসিয়ে পশিবে তোমার প্রাণে ।
তবে মুখানি তুলিয়ে চাও, সুধীরে মুখানি তুলিয়ে চাও ।
সখী, একটি চুম্বন দাও— গোপনে একটি চুম্বন দাও ॥"


গোলাপ ফুলকে ফুলের রাণী বলা হয়। রঙ, গন্ধ ও সৌন্দর্যের জন্য গোলাপ ফুল সবার কাছেই প্রিয়। যার কারণে এই ফুলের চাহিদাও অনেক বেশি।
তাহলে চলুন জেনে নেই গোলাপ চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে।
গোলাপ শীত ও নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের ফুল। অধিক উষ্ণ ও আর্দ্রতায় গোলাপ ভাল হয়না। ২২-৩০ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রা, ৮৫% আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং ১০০-১২৫ সেমি গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত গোলাপ চাষের জন্য উপযোগী। গোলাপ চাষের জন্য ৬.০-৬.৫ pH মানযুক্ত সুনিষ্কাশিত এবং উর্বর দোঁ-আশ মাটি উত্তম।ফুলের গুনগতমান সূর্যালোকের উপস্থিতির উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। এক্ষেত্রে বিকাল অপেক্ষা সকালের রোদ বেশি কার্যকর।
পৃথিবীতে অনেক জাতের গোলাপ আছে।

  কতকগুলো জাত হলোঃ মিরান্ডি, পাপা মেলান্ড, ডাবল ডিলাইট, তাজমহল, প্যারাডাইস, ব্লু-মুন, মন্টেজুমা, টাটা সেন্টার, সিটি অব বেলফাষ্ট ইত্যাদি
এ ছাড়াও রানি এলিজাবেথ (গোলাপি), ব্ল্যাক প্রিন্স (কালো), ইরানি (গোলাপি), মিরিন্ডা (লাল), দুই রঙা ফুল আইক্যাচার চাষ করা হয়।

  অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত গোলাপের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। কাটিং, গুটিকলম ও ‘টি’ বাডিং এর মাধ্যমে গোলাপের বংশবিস্তার করা হয়। কাটিং ও গুটি কলম জুলাই-আগস্ট মাসে। রোজ এবং ‘টি’ বাডিং ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে শেষ করতে হয়।
এঁটেল মাটি গোলাপ চাষের জন্য ভাল নয়। টবের জন্য সার মাটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে মাটি বেশ ফাঁপা থাকে এবং পানি না দাঁড়ায়। ১ ভাগ দো-আঁশ মাটি, ৩ ভাগ গোবর সার বা কম্পোষ্ট, ১ ভাগ পাতা পচা সার, আধ ভাগ বালি (নদীর সাদা বালি হলে ভাল হয়) দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে তাতে এক মুঠো সরিষার খৈল ও এক চামচ চুন মিশিয়ে ১টি ২০ সেঃমিঃ (৮ ইঞ্চি) টবে একমাস রেখে দিতে হবে। এই একমাস টবে জল  দিয়ে মাটি উল্টে পাল্টে দিতে হয়। এতে মাটির মিশ্রণ ভাল হবে। অনেকে মাটির মিশ্রণে ব্যবহৃত চা পাতা ব্যবহার করেও ভাল ফল পেয়েছেন। টবে নিচের কয়েক সেঃমিঃ পরিমাণ অংশে ইট বা মাটির হাড়ি পাতিলের ভাংগা টুকরা এমন ভাবে বিছিয়ে দিতে হয় যাতে টবের মাটি এগুলোর উপর থাকে। এতে বাড়তি জল  নিকাশের সুবিধা হবে।
কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে গোলাপ ফুলের গাছে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশেপাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদির স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
চারা রোপণের পর, চারার গোড়ায় প্রাথমিক অবস্থায় ঘন ঘন পানি দিতে হবে। চারা মাটিতে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নতুন ডালপালা ছাড়ার পর খরা মৌসুমে প্রতিদিন একবার সেচ দিলেই চলবে। ১০/১২ দিন পর পর গাছের গোড়ার মাটি ঝরঝরে করে দিতে হবে।
চারার জোড়া জায়গাটির নিচের অংশ থেকে অর্থাৎ শিকড় গাছ (Root stock) হতে কোন ডালপালা বের হলে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে দিতে হবে।
গাছের প্রথম দিকে বের হওয়া পুষ্পকুঁড়ি ভেঙ্গে দিলে পরবর্তীতে গাছ বড় আকারের ফুল দিবে। মার্চ-এপ্রিল মাসে  গোবর এবং কম্পোস্ট সার  গাছের গোড়ায় দিতে হবে। বয়স্ক ডালে ফুল ভালো হয় না। তাই সাধারণত অক্টেবর-নভেম্বর মাসে গোলাপ গাছের ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। ছাঁটাইয়ের সময় মরা ডাল, রোগাক্রান্ত ডালপালা ইত্যাদি ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে ফেলতে হবে। গাছের বৃদ্ধির উপর নজর রেখে গোলাপ গাছে হালকা, মধ্যম এবং ভারী ছাঁটাই করতে হয়। প্রথম বছরে গাছ ছাঁটাইয়ের কোন প্রয়োজন হয় না। ছাঁটাইকৃত ডাল যেন শুকিয়ে না যায় তার জন্য ডালের সামনে ছত্রাকনাশক ঘন করে গুলে তুলির সাহায্যে লাগিয়ে দিতে হবে। ডাল পালা ছাঁটাইয়ের পর গোলাপ গাছের গোড়া থেকে ২০ সে.মি. দূরে গোল করে মাটি খুঁড়ে শেকড়কে বের করে দিতে হবে। ৮-১০ দিন এ অবস্থায় রেখে দিলে শেকড়ে বাতাস ও রোদ লাগবে। এতে গাছের গোড়ায় থাকা ক্ষতিকর পোকামাকড় ধ্বংস হবে।
খোলা-মেলা আলো বাতাসপূর্ণ এমন স্থানে টব রাখতে হবে যাতে সকালের সূর্য কিরণ পায় এবং অন্ততঃ ৬-৮ ঘন্টা রোদ পায়। বিকেলের রোদ (বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে) না লাগানোই ভাল, কেননা এতে ফুলের রং ফ্যাকাসে হয়ে যায়। গোলাপ গাছটিতে যাতে চারিদিক হতেই আলো পড়ে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। তা না হলে গাছটি কেবল আলোর দিক দিয়েই বাড়বে। এজন্য টবসহ গাছটি মাঝে মাঝে ঘুরিয়ে নিতে হয়। গ্রীষ্মের প্রখর রোদ থেকে টবের গোলাপ গাছকে রক্ষা করার জন্য পর্যায়ক্রমে রোদ ও ছায়ায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টব রাখলে গাছ ভাল থাকবে। ফুলও বেশি দিন ধরে পাওয়া যাবে।
টবের আকার নির্ভর করে যে গোলাপের চাষ করা হবে তার জাতের উপর। ছোট জাতের জন্য ২০ সেঃমিঃ (৮ ইঞ্চি) টব ভাল, বড় জাতের জন্য ৩০ সেঃমিঃ (১২ ইঞ্চি) বা আরো বড় টব ব্যবহার করতে হয়। তবে প্রথম বছর যে আকারের টবে গাছ বসানো হবে পরের বছর বড়- আকারের টবে গাছ স্থানান্তর করলে বড় আকারের বেশী ফুল পাওয়া যায়।
বছরের যে কোন সময়ই টবে গোলাপের চারা বসানো যায়। তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস চারা লাগানোর উত্তম সময়। এসময় চারা লাগালে বেশী দিন ধরে ফুল পাওয়া যায়, গাছের পরিচর্যা করতে সুবিধা হয, রোগ পোকার আক্রমণও কম থাকে।


ফটো :- ঋতা নন্দী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন